পাকিস্তানের দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে কারফিউ জারি

পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তান জেলায় নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতির কারণে কারফিউ জারি করা হয়েছে। সোমবার সকাল ছয়টা থেকে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত জেলায় জনসাধারণের চলাচলের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বৃদ্ধির আশঙ্কার কারণে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গতকাল রোববার নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষ থেকে কারফিউ জারির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। চলমান উত্তেজনার কারণে দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানসহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে নজরদারি জোরদার করা হয়েছে। নিরাপত্তা সংস্থাগুলো জানিয়েছে, সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রম বৃদ্ধি পাওয়ায় এই অঞ্চলে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি হয়ে উঠেছে।
পূর্ববর্তী হামলাগুলোর পর্যালোচনা:
গত কয়েক দিনে উত্তর ও দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তান জেলায় একাধিক সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে। কারফিউ জারির মাত্র তিন দিন আগে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এক তল্লাশিচৌকিতে সশস্ত্র হামলাকারীদের আক্রমণ নস্যাৎ করতে সক্ষম হয়। ওই সংঘর্ষে ১০ জন হামলাকারী নিহত হয়েছিল।
এ ছাড়া দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানের জানদোলা এলাকায় সম্প্রতি একটি আত্মঘাতী হামলার ঘটনা ঘটে। নিরাপত্তা সূত্র জানায়, এই হামলায় বেশ কয়েকজন হতাহত হয়েছেন। তবে এ ঘটনার পেছনে কারা রয়েছে, সে বিষয়ে এখনো নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
এক দিন পর দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানের একটি মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে, যাতে অন্তত চারজন আহত হন। আহতদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রাজনৈতিক দল জামিয়াত উলেমা ইসলাম–ফজলের (জেইউআই-এফ) জেলা আমির। নিরাপত্তা বাহিনী মনে করছে, এই বিস্ফোরণের লক্ষ্যবস্তু ছিলেন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতারা।
নিরাপত্তা পরিস্থিতি ও সাম্প্রতিক সহিংসতা:
পাকিস্তানে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সন্ত্রাসী হামলার সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। পাকিস্তান ইনস্টিটিউট ফর কনফ্লিক্ট অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ (পিআইসিএসএস)-এর এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তানজুড়ে সশস্ত্র হামলার সংখ্যা আগের মাসের তুলনায় ৪২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
জানুয়ারি মাসে পাকিস্তানে কমপক্ষে ৭৪টি সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে, যেখানে মোট ৯১ জন প্রাণ হারিয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ৩৫ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য, ২০ জন বেসামরিক মানুষ এবং ৩৬ জন হামলাকারী ছিলেন। এ ছাড়া ওই মাসে ৫৩ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য, ৫৪ জন বেসামরিক ব্যক্তি ও ১০ জন সশস্ত্র হামলাকারী আহত হয়েছেন।
সন্ত্রাসী হামলার মূল কেন্দ্র:
পিআইসিএসএস-এর পরিসংখ্যান অনুসারে, জানুয়ারিতে সবচেয়ে বেশি সহিংসতা খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে সংঘটিত হয়েছে। এই প্রদেশে ৪৬টি সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় ৬৫ জন নিহত হন। বেলুচিস্তান প্রদেশ ছিল দ্বিতীয় স্থানে, যেখানে ২৪টি হামলায় ২৬ জনের প্রাণহানি হয়।
দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে সম্প্রতি হামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর পুনরায় সংগঠিত হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। বিশেষ করে তালেবান সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা বাড়ছে বলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্য বলছে।
সরকারের প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ:
সরকারি ও নিরাপত্তা বাহিনীর সূত্রমতে, বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তান ও আশপাশের এলাকায় ব্যাপক সামরিক অভিযান পরিচালনার পরিকল্পনা রয়েছে। সেনাবাহিনী ও আধাসামরিক বাহিনী ইতোমধ্যে অভিযান শুরু করেছে এবং বিভিন্ন সন্দেহভাজন এলাকায় তল্লাশি চালানো হচ্ছে।
পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ বিষয়ে বলেছেন, “সরকার জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেবে। যারা দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করার চেষ্টা করছে, তাদের কঠোর হস্তে দমন করা হবে।” তিনি আরও জানান, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে আরও সক্রিয় করা হয়েছে এবং স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় বাড়ানো হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রতিক্রিয়া:
কারফিউ জারির ফলে দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানের বাসিন্দাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য জনসেবা সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে।
স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, “আমরা দীর্ঘদিন ধরে অশান্তির মধ্যে রয়েছি। সরকার যদি দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়, তাহলে হয়তো আমরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারব।” তবে কিছু নাগরিক আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, দীর্ঘমেয়াদি কারফিউ তাদের জীবনযাত্রার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
উপসংহার:
দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানের বর্তমান নিরাপত্তা পরিস্থিতি পাকিস্তানের সামগ্রিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলা এবং সহিংসতার ঘটনায় স্পষ্ট হয়েছে যে, এই অঞ্চলে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো পুনরায় সক্রিয় হয়ে উঠছে।
সরকারের নেওয়া পদক্ষেপ ও সামরিক অভিযানের সফলতা নির্ভর করবে তাদের কৌশলের ওপর। তবে স্থায়ী সমাধানের জন্য কেবল সামরিক ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়; রাজনৈতিক সংলাপ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং স্থানীয় জনগণের আস্থার পুনরুদ্ধারও জরুরি। ভবিষ্যতে দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তান এবং সমগ্র পাকিস্তানে শান্তি বজায় থাকবে কি না, তা নির্ভর করবে সরকারের কার্যকর নীতির ওপর।