বানিজ্য

এত সয়াবিন আমদানি, তবু সংকট কেন

সয়াবিন তেল বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ভোজ্যতেল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে দেশে সয়াবিন তেলের সংকট ও মূল্যবৃদ্ধি ভোক্তাদের মধ্যে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজারে তেলের সরবরাহ কমে যাওয়া এবং মূল্যবৃদ্ধির পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে, যা আমরা এই প্রতিবেদনে বিশ্লেষণ করব।

সয়াবিন তেলের আমদানি ও সরবরাহ পরিস্থিতি

ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে প্রতিদিন সয়াবিন তেলের কাঁচামাল খালাস হচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ১১ মার্চ পর্যন্ত ১৭ দিনে সাতটি শিল্প গ্রুপ এক লাখ টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেল খালাস করেছে। এছাড়া, একই সময়ে দুই লাখ টন সয়াবিনবীজ খালাস হয়েছে, যা থেকে ৩৬ হাজার টন সয়াবিন তেল উৎপাদিত হতে পারে। এই আমদানি বৃদ্ধির পরও বাজারে তেলের সংকট কাটেনি।

বাজারে তেলের দাম ও সংকট

চট্টগ্রামের চকবাজার ও বহদ্দারহাটের খুচরা বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের মজুত কম। দোকানিরা পাঁচ লিটারের বোতল ৯০০ টাকার বেশি দামে বিক্রি করছেন, যেখানে বোতলের গায়ে ৮৫০ টাকা দাম লেখা। এক লিটারের বোতলের দাম ১৮৫ টাকা পর্যন্ত চাওয়া হচ্ছে। খুচরা বিক্রেতারা দাবি করছেন, পরিবেশকেরা পর্যাপ্ত তেল সরবরাহ করছেন না, যার ফলে দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্রেতারা অভিযোগ করছেন, বোতলের গায়ে লেখা দাম মুছে দিয়ে বেশি দামে তেল বিক্রি করা হচ্ছে।

শুল্কছাড়ের মেয়াদ ও মজুত প্রবণতা

ভোজ্যতেলের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকার সয়াবিন তেলের শুল্ক-কর কমিয়ে ৫ শতাংশে নামিয়েছিল, যা ৩১ মার্চ পর্যন্ত কার্যকর। এরপর স্বাভাবিক শুল্ক-কর কার্যকর হবে, যা লিটারপ্রতি সয়াবিন তেলের দামে ১৪-১৫ টাকা বাড়াতে পারে। এই আশঙ্কায় মজুত প্রবণতা বাড়ছে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের খতিবের হাট এলাকায় এক দোকান থেকে ৬,৭০০ লিটার বোতলজাত সয়াবিন উদ্ধার করেছে। অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ ফয়েজ উল্যাহ জানান, মজুতদারির কারণে বাজারে সংকট তৈরি হচ্ছে, এবং বোতলের গায়ে লেখা দামের চেয়ে বেশি বিক্রি হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব ও মূল্যবৃদ্ধি

আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ এডিবল ওয়েল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা হায়দার জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্য তেলের দাম প্রতি টন ১,২০০ ডলারের কাছাকাছি চলে গেছে। এর প্রভাবে দেশে সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৮ টাকা বাড়ানো হয়েছে। এখন বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ১৭৫ টাকা, এবং খোলা সয়াবিন তেল ১৫৭ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

সরবরাহ সংকট ও মজুতদারি

বাজারে সয়াবিন তেলের সরবরাহ সংকটের পেছনে মজুতদারির অভিযোগ উঠেছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান জানান, কিছু ডিলার ও পাইকারি বিক্রেতা মজুতদারির মাধ্যমে সংকট সৃষ্টি করেছে। গত ১৫ দিনে প্রায় ১,০০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সরবরাহ ঠিক থাকলে কেউ অযাচিতভাবে দাম বাড়াতে পারবে না।

সরকারের পদক্ষেপ ও সুপারিশ

সরকার ভোজ্যতেলের মূল্য নির্ধারণ ও বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন জানান, মজুতদারি তৎপরতার বিরুদ্ধে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কাজ করছে। এছাড়া, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে তেলের দাম নির্ধারণ করা হচ্ছে। সরবরাহ ঠিক রাখতে মিল মালিকদের সঙ্গে সমন্বয় করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

ভোক্তাদের করণীয়

বর্তমান পরিস্থিতিতে ভোক্তাদের সচেতন হতে হবে। বাজারে তেলের সংকট ও মূল্যবৃদ্ধির সময় অতিরিক্ত তেল মজুত না করে সঠিক পরিমাণে তেল ক্রয় করা উচিত। এতে করে মজুতদারির প্রবণতা কমবে এবং বাজারে তেলের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকবে। এছাড়া, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের হটলাইনে (১৬১২১) অভিযোগ জানিয়ে মজুতদারি ও অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সহায়তা করা যেতে পারে।

সয়াবিন তেলের সংকট ও মূল্যবৃদ্ধি একটি জটিল সমস্যা, যা সমাধানে সরকার, ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button