ভারতীয় ঋণের প্রকল্পে অর্থছাড় কমেছে: যাচাই-বাছাইয়ের উদ্যোগ

বাংলাদেশে ভারতীয় ঋণের অর্থছাড় কাঙ্ক্ষিত হারে হচ্ছে না। গত সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) ভারত মাত্র আট কোটি ডলারের মতো অর্থছাড় করেছে। ভারতীয় গুচ্ছ ঋণ বা লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) আওতায় এই অর্থ দেওয়া হচ্ছে। একদিকে অর্থছাড় কমেছে,
অন্যদিকে নতুন ঋণের প্রতিশ্রুতিও মিলছে না।
অর্থছাড়ের বর্তমান চিত্র
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, এলওসির আওতায় গত জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত ভারত ৮ কোটি ১ লাখ ৫০ হাজার ডলার ছাড় করেছে। এই সময়ে ভারত নতুন ঋণের কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি। গত অর্থবছরের পুরো সময়ে যত অর্থছাড় হয়েছে, চলতি অর্থবছরের সাত মাসে তার চার ভাগের এক ভাগ ছাড় হয়েছে।
প্রকল্পের কাজ বন্ধ
গত আগস্টে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ভারতের বেশ কয়েকটি প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। বিশেষ করে আশুগঞ্জ-আখাউড়া চার লেনের সড়কের ভারতীয় ঠিকাদাররা দেশে ফিরে যান, ফলে চার মাসের মতো প্রকল্পটির কাজ বন্ধ ছিল। এমন আরও কয়েকটি প্রকল্প আছে, যেখানে ভারতীয় ঠিকাদার কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন বা কাজের গতি কমে গেছে। এসব কারণে এলওসির অর্থছাড় কমে গেছে বলে মনে করছেন ইআরডি কর্মকর্তারা।
যাচাই-বাছাইয়ের উদ্যোগ
এদিকে, এলওসির অর্থে নেওয়া প্রকল্পগুলো যাচাই-বাছাই করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দুই দেশের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “নতুন প্রেক্ষাপটে কোন প্রকল্প অগ্রসর করা হবে, কোনটা করা হবে না, এসব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তাই হয়তো অর্থছাড় কমেছে।”
জরুরি প্রকল্পের প্রয়োজন
তিনি আরও বলেন, “অর্থনীতির জন্য জরুরি এমন প্রকল্পই এলওসির আওতায় রাখা উচিত।” প্রকল্পের কেনাকাটার শর্ত শিথিল করা নিয়ে কতটা অগ্রগতি হয়, তা–ও এখন দেখার বিষয়।
অতীতের অর্থছাড়ের চিত্র
গত জানুয়ারি মাস পর্যন্ত ভারত সব মিলিয়ে এলওসির আওতায় ১৮৮ কোটি ডলার ছাড় করেছে। ২০১০, ২০১৬ ও ২০১৭ সালে তিনটি এলওসিতে বাংলাদেশকে মোট ৭৩৬ কোটি ডলার ঋণ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু প্রতিশ্রুতির পরও কাঙ্ক্ষিত হারে অর্থছাড় হয়নি।
গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বশেষ তিন বছরে ৩০ কোটি ডলারের বেশি অর্থছাড় করেছে ভারত। ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারতের এক্সিম ব্যাংক ৩১ কোটি ১৪ লাখ ডলার ছাড় করেছে। এর আগের দুই অর্থবছরে যথাক্রমে ৩৩ কোটি ৭০ লাখ ও ৩২ কোটি ৯৩ লাখ ডলার ছাড় হয়েছে।
প্রকল্প তালিকা যাচাই-বাছাই
তিনটি এলওসিতে সড়ক ও রেল যোগাযোগ, জ্বালানি, রাস্তাঘাট নির্মাণসহ অবকাঠামো খাতে এ পর্যন্ত ৩৬টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৫টি শেষ হয়েছে এবং চলমান আছে আটটি প্রকল্প। বাকি ১৩টি প্রকল্প পরামর্শক ও ঠিকাদার নিয়োগ কিংবা প্রকল্প প্রস্তাবনা তৈরির পর্যায়ে রয়েছে।
৫ ও ৬ মার্চ দুই দেশের মধ্যে অনুষ্ঠিত এলওসি পর্যালোচনা সভায় প্রকল্প তালিকা আবার যাচাই-বাছাই করার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) অতিরিক্ত সচিব মিরানা মাহরুখ এবং ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের লাইন অব ক্রেডিটের পরিচালক সুজা কে মেনন নিজ নিজ দেশের পক্ষে সভায় নেতৃত্ব দেন।
সমাধানের জন্য কমিটি
জানা গেছে, এলওসির প্রকল্পগুলো যাচাই-বাছাই করার জন্য একটি কমিটি থাকবে। এই কমিটি প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলো কেন দীর্ঘসূত্রতায় পড়ল, তা খুঁজে বের করে সমাধানের চেষ্টা করবে। প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো থেকে শুরু করে প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যন্ত সমস্যা চিহ্নিত করা হবে। প্রয়োজনে প্রকল্প বাদ দেওয়ার সুপারিশ করবে এই কমিটি।
ভারতীয় ঋণের প্রকল্পে অর্থছাড় কমে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে প্রভাব পড়তে পারে। নতুন প্রকল্পের যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে সরকার আশা করছে, অর্থছাড়ের হার বাড়বে এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।