কর্মসংস্থান ব্যাংকের ‘বঙ্গবন্ধু যুব ঋণ’ এখন গলার কাঁটা

শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে কর্মসংস্থান ব্যাংকের অধীনে ‘বঙ্গবন্ধু যুব ঋণ’ প্রকল্প চালু করা হয়েছিল। জামানত ছাড়াই ২০ হাজার থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল এই কর্মসূচির মূল লক্ষ্য। তবে বাস্তবে এটি এখন বড় ধরনের সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দলীয়করণের অভিযোগ
সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা এই ব্যাংকটি দলীয় কর্মীদের নজিরবিহীনভাবে ঋণ প্রদানের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অনেক অযোগ্য ব্যক্তিও দলীয় সুপারিশের ভিত্তিতে ঋণ পেয়েছেন। ফলে ঋণ এখন একে একে খেলাপি হয়ে যাচ্ছে।
একজন ব্যাংক শাখা ব্যবস্থাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ২০২১ সালে ‘বঙ্গবন্ধু যুব ঋণ’ নামে একটি নতুন ঋণ প্রকল্প চালু করা হয়। কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সরকারকে খুশি করতে অতিরিক্ত উদ্দীপনার সঙ্গে ঋণ বিতরণ করেছেন। ফলে বেশির ভাগ ঋণ আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা পেয়েছেন। ঋণের পরিমাণ কম হলেও প্রান্তিক নেতাদের জন্য পাঁচ লাখ টাকাও অনেক।
কিস্তি পরিশোধে অনীহা ও ঋণ খেলাপি বৃদ্ধি
আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে কিস্তি পরিশোধ না করেও নিয়মিত গ্রাহক হিসেবে চিহ্নিত ছিলেন অনেকে। তবে সরকার পরিবর্তনের পর অনেকেই ঋণের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হচ্ছেন বা আত্মগোপনে চলে গেছেন। ফলে ঋণ খেলাপির সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, কর্মসংস্থান ব্যাংক বঙ্গবন্ধু যুব ঋণ প্রকল্পের আওতায় মোট ৩,৭০০ কোটি টাকা বিতরণ করেছে। এর মধ্যে ৭০০ কোটি টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক দিয়েছে এবং বাকিটা ব্যাংকটির নিজস্ব তহবিল থেকে সংযোজিত হয়েছে।
ব্যাংকের লাভের ওপর প্রভাব
কর্মসংস্থান ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অরুণ কুমার চৌধুরী জানান, মুজিববর্ষ উপলক্ষে ব্যাংকটি দুই লাখেরও বেশি মানুষকে ঋণ দিয়েছে। তিনি দাবি করেন, তাদের খেলাপি ঋণের হার মাত্র ২.৫%। তবে পরিসংখ্যান বলছে, এই প্রকল্পে ১০৫ কোটি টাকার বেশি ঋণ ইতোমধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে।
ব্যাংকিং নীতিমালা অনুযায়ী, প্রতিটি ব্যাংককে তাদের পরিচালন মুনাফার নির্দিষ্ট অংশ ঋণের প্রভিশন হিসেবে সংরক্ষণ করতে হয়। নিম্নমানের খেলাপি ঋণের বিপরীতে ২০% এবং সন্দেহজনক খেলাপির ক্ষেত্রে ৫০% সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক। ফলে কর্মসংস্থান ব্যাংক ইতোমধ্যে এ ঋণের বিপরীতে ছয় কোটি ৮২ লাখ টাকা মুনাফা হারিয়েছে।
জাতীয় ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের ভয়াবহতা
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, দেশে তিন লাখ কোটি টাকার বেশি ঋণ খেলাপি রয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হিসাব পরিবর্তন করা হলে প্রকৃত খেলাপির পরিমাণ পাঁচ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
কর্মসংস্থান ব্যাংক ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বেকার যুবকদের অর্থ সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে। ব্যাংকের অনুমোদিত মূলধন এক হাজার কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন ৫৫৯ কোটি টাকা। সরকারি ও প্রাতিষ্ঠানিক আমানতই এ ব্যাংকের বিনিয়োগের মূল উৎস। কিন্তু বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় ব্যাংকটির ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
উপসংহার
‘বঙ্গবন্ধু যুব ঋণ’ কর্মসূচি মূলত আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং বেকার যুবকদের জন্য একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে চালু করা হয়েছিল। তবে যথাযথ তদারকি ও সুপারিশের ভিত্তিতে ঋণ বিতরণের কারণে এটি এখন ব্যাংকের জন্য বড় ধরনের আর্থিক ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে কঠোর নজরদারি ও কার্যকর পুনরুদ্ধার ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি হয়ে পড়েছে।