মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেন ২৫ লাখ কোটি ছাড়িয়ে যাবে: গভর্নর

বাংলাদেশে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) খাতের অগ্রগতি অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, চলতি বছরে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেনের পরিমাণ ২৫ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। বর্তমানে এমএফএসে বছরে প্রায় ১৭ লাখ কোটি টাকার লেনদেন হয়, যা আগের তুলনায় অনেক বেশি।
রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে মঙ্গলবার আয়োজিত ‘লেনদেনব্যবস্থার রূপান্তর: বিবর্তনের যুগ’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে গভর্নর এই তথ্য জানান। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর জাকির হোসেন চৌধুরী, বিভিন্ন ব্যাংকের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, পেমেন্ট সিস্টেম বিশেষজ্ঞ এবং সংশ্লিষ্ট খাতের অন্যান্য প্রতিনিধিরা।
এমএফএস লেনদেনের রেকর্ড প্রবৃদ্ধি
গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, মোবাইল ব্যাংকিং সেবার ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে এবং এটি দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। তিনি বলেন, “বর্তমানে এমএফএসে যে লেনদেন হচ্ছে, তা জাতীয় বাজেটের প্রায় তিন গুণের সমান। এটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।”
এমএফএস খাতের দ্রুত অগ্রগতির অন্যতম কারণ হিসেবে তিনি ডিজিটাল পেমেন্টের ব্যাপক বিস্তার, ই-কমার্স ও অনলাইন ব্যবসার প্রসার, নগদবিহীন লেনদেনের জনপ্রিয়তা এবং সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ উদ্যোগকে উল্লেখ করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ দেশে মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টের সংখ্যা প্রায় ১৪ কোটি ছাড়িয়েছে। দৈনিক গড়ে ৪০ হাজার কোটি টাকা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন হচ্ছে, যা এক দশক আগেও অকল্পনীয় ছিল।
আরটিজিএস ব্যবস্থার আধুনিকায়ন
বাংলাদেশ ব্যাংক আরটিজিএস (রিয়েল টাইম গ্রস সেটেলমেন্ট) ব্যবস্থার আধুনিক সংস্করণ চালু করেছে, যা সপ্তাহের সাত দিন ২৪ ঘণ্টা লেনদেনের সুবিধা দেবে।
এই প্রসঙ্গে গভর্নর বলেন, “আরটিজিএস ব্যবস্থা চালুর সময় আমরা এর গুরুত্ব বুঝিনি, কিন্তু এখন এটি অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেম বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মো. খায়রুল আনাম বলেন, ব্যাংক লেনদেনের ৮৪ শতাংশই বর্তমানে ডিজিটাল মাধ্যমে হয়। এর মধ্যে ৫৬ শতাংশ বিভিন্ন ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেমে এবং ২৮ শতাংশ এমএফএস প্ল্যাটফর্মে সম্পন্ন হয়।
আরটিজিএস ব্যবস্থার মাধ্যমে এখন সাতটি মুদ্রায় লেনদেন করা যায়, যার মধ্যে রয়েছে টাকা, মার্কিন ডলার, ব্রিটিশ পাউন্ড, ইউরো, জাপানি ইয়েন, চীনা ইউয়ান ও ভারতীয় রুপি।
তিনি আরও জানান, “দেশের ১১ হাজার ৬২০টি ব্যাংক শাখা বর্তমানে আরটিজিএস ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত। প্রতিদিন গড়ে ৪৮ হাজার ৪১০টি লেনদেন হয় এবং এর দৈনিক গড় লেনদেনের পরিমাণ ২২ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা।”
ডিজিটাল লেনদেনের সুরক্ষা ব্যবস্থা
ইস্টার্ণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী রেজা ইফতেখার বলেন, “আমরা প্রতিনিয়ত সাইবার হামলার ঝুঁকির মুখে থাকি। ডিজিটাল লেনদেন যত বাড়বে, ততই সাইবার হুমকি বৃদ্ধি পাবে। সে জন্য সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও উন্নত করতে হবে।”
বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে সাইবার নিরাপত্তা নীতি শক্তিশালী করার পরিকল্পনা নিয়েছে। ব্যাংকিং ও পেমেন্ট সিস্টেমের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেন্ট্রাল মনিটরিং সিস্টেম (CMS) চালুর বিষয়টিও আলোচনায় রয়েছে।
এমএফএস খাতের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে ১১টি মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বিকাশ, নগদ, রকেট, ইউপে ও এমক্যাশের মতো সেবাগুলো এখন গ্রাহকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে মোবাইল ব্যাংকিং ৫০ লাখ কোটি টাকার লেনদেন ছাড়িয়ে যেতে পারে, কারণ ডিজিটাল লেনদেনের প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান বলেন, “ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থার অগ্রগতি আমাদের অর্থনীতিকে আরও গতিশীল করছে। বিশেষ করে, দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এখন সহজেই আর্থিক লেনদেনের সুযোগ পাচ্ছে।”
উপসংহার
বাংলাদেশে ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেমের দ্রুত বিকাশ দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেনের পরিমাণ যেভাবে বাড়ছে, তাতে দেশের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি আরও বিস্তৃত হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তবে ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সাইবার ঝুঁকি মোকাবিলা করা এবং সেবার মান উন্নত করার বিষয়গুলো এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই আধুনিকায়ন ও উদ্যোগগুলো যদি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে আগামী দিনে দেশের ডিজিটাল ব্যাংকিং খাত আরও সমৃদ্ধ হবে।