প্রযুক্তি

বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ‘গুপ্তচর ক্যামেরা’ বানিয়ে সাড়া ফেলল চীন

বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ‘গুপ্তচর ক্যামেরা’ তৈরি করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে চীন। দেশটির বিজ্ঞানীরা অপটিক্যাল ইমেজিং প্রযুক্তিতে এক নতুন বিপ্লব ঘটিয়েছেন, যা নজরদারি এবং সামরিক গোয়েন্দাগিরির ক্ষেত্রে এক অভূতপূর্ব উন্নতি আনতে পারে।

নতুন লেজার ক্যামেরার সক্ষমতা

চীনের বিজ্ঞানীরা এমন এক লেজার ক্যামেরা তৈরি করেছেন যা নিম্ন-কক্ষপথ (Low-Earth Orbit) থেকে মানবমুখের মতো সূক্ষ্ম বিশদ শনাক্ত করতে পারে। এটি চীনের সামরিক নজরদারি কার্যক্রমে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রযুক্তি বিদেশি সামরিক উপগ্রহগুলোর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য অভূতপূর্ব সুবিধা দেবে।

পরীক্ষা কিভাবে পরিচালিত হয়েছে?

গবেষক দল চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের কিংহাই লেক এলাকায় পরীক্ষাটি পরিচালনা করেন। লেকের উত্তর তীরে একটি সিন্থেটিক অ্যাপারচার লাইডার (Synthetic Aperture Lidar) সিস্টেম স্থাপন করা হয়, যা লেজার-ভিত্তিক চিত্রগ্রহণের একটি উন্নততর পদ্ধতি।

এই ডিভাইসটি ১০১.৮ কিলোমিটার দূরে স্থাপিত প্রতিফলিত প্রিজমের সারিকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে চিত্র সংগ্রহ করে। এতে ১.৭ মিলিমিটার পর্যন্ত সূক্ষ্ম বিশদ ধারণ করা সম্ভব হয়েছে, যা এতদিন পর্যন্ত অসম্ভব বলে মনে করা হতো। গবেষণা প্রতিবেদনটি ‘চাইনিজ জার্নাল অব লেজারস’-এ প্রকাশিত হয়েছে।

প্রযুক্তিগত অগ্রগতি

গবেষকরা একাধিক অভিনব প্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন, যা লেজার ক্যামেরাটিকে এত শক্তিশালী করেছে। এর কয়েকটি মূল উদ্ভাবন হলো:

১. বর্ধিত অপটিক্যাল অ্যাপারচার

৪×৪ মাইক্রো-লেন্স গ্রিড ব্যবহার করে লেজার বিমের বিস্তার বাড়ানো হয়েছে। এতে অপটিক্যাল অ্যাপারচার ১৭.২ মিমি থেকে ৬৮.৮ মিমিতে উন্নীত হয়। ফলে দীর্ঘ দূরত্বের চিত্রও অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ধারণ করা সম্ভব হয়েছে।

২. উন্নত লেজার সংকেত প্রক্রিয়াকরণ

চওড়া ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ড (১০ গিগাহার্টজ-এর বেশি) ব্যবহার করে সূক্ষ্ম রেঞ্জ রেজল্যুশন অর্জন করা হয়েছে। সংকীর্ণ রঙের স্পেকট্রামে লেজার রশ্মি ধরে রেখে আড়াআড়ি বিশদ আরও স্পষ্ট করা হয়েছে।

৩. শব্দ কমানোর উন্নত অ্যালগরিদম

বিশেষ অ্যালগরিদম ব্যবহার করে অপটিক্যাল শব্দ কমিয়ে আনা হয়েছে ১০,০০০ গুণ। ফলে দূরবর্তী বস্তুর খুব ক্ষীণ সংকেতও ধরা সম্ভব হয়েছে।

৪. শক্তিশালী লেজার প্রযুক্তি

প্রচলিত লাইডার সিস্টেমের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী ১০৩ ওয়াটের লেজার ব্যবহার করা হয়েছে। এটি দ্রুত ডেটা প্রসেস করতে সক্ষম এবং এর মাধ্যমে সুদূর মহাকাশ পর্যন্ত নজরদারি করা সম্ভব।

সামরিক গুরুত্ব ও প্রভাব

বেইজিং-ভিত্তিক এক ইমেজিং বিজ্ঞানী জানান, “এই ক্যামেরা শুধু স্যাটেলাইট নজরদারি করতে সক্ষম নয়, বরং এর সিরিয়াল নম্বরও পড়তে পারবে।”

এত উচ্চ রেজল্যুশনের ফলে উপগ্রহের ক্ষুদ্র ক্ষয়ক্ষতি (যেমন মাইক্রোমিটিওরয়েডের আঘাত) শনাক্ত করা যাবে। উপগ্রহের সেন্সর ও পেলোড (সজ্জিত যন্ত্রাংশ) চিহ্নিত করা সম্ভব হবে।

এই প্রযুক্তি মাইক্রোওয়েভ-ভিত্তিক সিন্থেটিক অ্যাপারচার রাডারের নীতির ওপর ভিত্তি করে তৈরি হলেও, অপটিক্যাল তরঙ্গদৈর্ঘ্যে কাজ করার কারণে এটি অনেক বেশি স্বচ্ছ ছবি তুলতে সক্ষম।

বিশ্বের অন্যান্য নজরদারি প্রযুক্তির তুলনায় অগ্রগতি

২০১১ সালে মার্কিন প্রতিরক্ষা ঠিকাদার লকহিড মার্টিন মাত্র ১.৬ কিলোমিটার দূর থেকে ২ সেন্টিমিটার রেজল্যুশন অর্জন করেছিল। পরে চীনের বিজ্ঞানীরা ৬.৯ কিলোমিটার দূর থেকে ৫ সেন্টিমিটার রেজল্যুশন অর্জন করতে সক্ষম হন।

এবার চীনা গবেষকরা ১০০ কিলোমিটার দূর থেকে মিলিমিটার-পর্যায়ের রেজল্যুশন অর্জন করেছেন, যা নজরদারি প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এক বিশাল অগ্রগতি।

প্রয়োগের সীমাবদ্ধতা

তবে বাস্তব পরিস্থিতিতে এই প্রযুক্তি ব্যবহারের কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে:

১. আবহাওয়ার ওপর নির্ভরতা

লেজার ইমেজিংয়ের গুণমান নির্ভর করে আবহাওয়ার স্বচ্ছতা, মেঘের উপস্থিতি ও বাতাসের গতির ওপর। খারাপ আবহাওয়ায় এর কার্যকারিতা কমে যেতে পারে।

২. গতিশীল লক্ষ্যবস্তুর ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা

চলমান লক্ষ্যবস্তু ট্র্যাক করার জন্য অত্যন্ত নিখুঁত যান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রয়োজন, যা তৈরি করা সহজ নয়। দ্রুতগতির বস্তু পর্যবেক্ষণে আরও উন্নত সেন্সর ও অ্যালগরিদম দরকার।

উপসংহার

চীনের এই নতুন লেজার-ভিত্তিক গুপ্তচর ক্যামেরা নজরদারি প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এটি চীনকে সামরিক পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থায় শীর্ষ অবস্থানে নিয়ে যেতে পারে। বিশেষ করে বিদেশি উপগ্রহের ক্ষুদ্রতম বিবরণ শনাক্ত করা, সেন্সর চিহ্নিত করা, এমনকি মহাকাশযানের ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণের মতো কাজে এটি ব্যবহৃত হতে পারে।

তবে বাস্তবিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে আবহাওয়া ও লক্ষ্যের গতি সংক্রান্ত সীমাবদ্ধতা এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button