অর্থনীতি

আড়াই লাখ কোটি টাকার লেনদেন: এস আলমের ব্যাংক হিসাবে

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি) একটি আলোচিত শিল্পগোষ্ঠীর ব্যাংক হিসাবে বিপুল পরিমাণ লেনদেনের তথ্য পেয়েছে। এস আলম গ্রুপের ব্যাংক হিসাবে ২ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য বিশ্লেষণ করছে সংস্থাটি। গত এক মাস ধরে সাতজন কর কর্মকর্তা ১০টি কম্পিউটারে এসব লেনদেনের তথ্য এন্ট্রি করেও কাজ সম্পূর্ণ করতে পারেননি।

মানি লন্ডারিং ও কর ফাঁকি রোধে এনবিআরের পদক্ষেপ

রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এনবিআরের প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত ‘মানি লন্ডারিং ও কর ফাঁকি রোধে পারস্পরিক সহযোগিতা’ বিষয়ক এক কর্মশালায় এসব তথ্য প্রকাশ করেন এনবিআরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

কর্মশালায় সিআইসির মহাপরিচালক আহসান হাবিব বলেন, “আমাদের কাছে একটি শিল্পগোষ্ঠীর ব্যাংক হিসাবে ২ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য রয়েছে। সাতজন কর কর্মকর্তা এক মাসেও ১০টি কম্পিউটারে এই লেনদেনের তথ্য এন্ট্রির কাজ শেষ করতে পারেননি।”

তিনি আরও জানান, ২০২৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত এস আলম গ্রুপের ব্যাংক হিসাবে স্থিতি ছিল ৩৬ হাজার কোটি টাকা। এই হিসাবে বিপরীতে তারা সুদ হিসেবে পেয়েছে ৬ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা, তবে এই অর্থের বড় অংশ আয়কর নথিতে উল্লেখ করা হয়নি। এনবিআর বর্তমানে এ নিয়ে কাজ করছে।

সন্দেহভাজন কর ফাঁকিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান

এনবিআরের কর্মকর্তারা জানান, দেশের শীর্ষ শিল্পগোষ্ঠীগুলোর ব্যাংক লেনদেন খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সন্দেহভাজন কর ফাঁকিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ব্যাংক কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আহসান হাবিব বলেন, “অলিগার্করা আর ফিরে আসবে না। আপনারা ভুলে যান, কীভাবে চাকরি পেয়েছেন। সন্দেহভাজন কর ফাঁকিবাজদের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করুন।”

তিনি আরও অভিযোগ করেন যে, কর ফাঁকির তথ্য দিতে অনেক ব্যাংক কর্মকর্তা গড়িমসি করছেন। এ প্রসঙ্গে এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, “ব্যাংকের আইনি দায়িত্ব হচ্ছে এনবিআরের চাহিদা অনুযায়ী তথ্য সরবরাহ করা। তথ্য না দিলে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

শীর্ষ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলোর তদন্তে এনবিআর

গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এনবিআর শীর্ষ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলোর কর ফাঁকি তদন্ত শুরু করে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশের অন্যতম শীর্ষ শিল্পগোষ্ঠী ও ব্যবসায়ীদের লেনদেন খতিয়ে দেখছে এনবিআর।

এই তদন্তের আওতায় রয়েছে এস আলম গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপ, সামিট গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ, ও নাসা গ্রুপ। তদন্তে উঠে আসা তথ্য অনুযায়ী, এসব গোষ্ঠীর ব্যাংক লেনদেনে ব্যাপক অসংগতি রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ অর্থ উত্তোলন করা হলেও এর সুনির্দিষ্ট উৎস জানা যাচ্ছে না।

এলটিইউ কমিশনার খায়রুল ইসলাম বলেন, “অনেকের ব্যাংক হিসাব বিবরণী এনে দেখেছি, প্রতিদিন বিপুল অর্থ উত্তোলন হচ্ছে। কিন্তু এই অর্থ কোথায় যাচ্ছে, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। ব্যাংক কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসা করলে তারা সঠিক উত্তর দিতে পারছেন না।”

মানি লন্ডারিং ও কর ফাঁকি রোধে নতুন পদক্ষেপ

কর ফাঁকি ও মানি লন্ডারিং রোধে এনবিআর বেশ কিছু কৌশল গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য:

  • সন্দেহভাজন লেনদেনের ওপর কঠোর নজরদারি
  • ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমন্বয় বৃদ্ধি
  • বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলোর কর নথি পুনর্মূল্যায়ন
  • দ্রুত তদন্তের মাধ্যমে কর ফাঁকিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ

ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া

এনবিআরের এই তদন্ত নিয়ে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেকেই বলছেন, রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে সরকার নতুন অর্থনৈতিক নীতির দিকে যাচ্ছে।

এক শীর্ষ ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “বাংলাদেশের অনেক বড় ব্যবসায়ী বছরের পর বছর ধরে সরকারি সুবিধা নিয়ে ব্যবসা করেছেন। এখন যদি তদন্ত হয়, তবে তাদের বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে হবে।”

অপরদিকে, ভোক্তাদের অনেকে মনে করছেন, কর ফাঁকি কমলে সরকার আরও বেশি সামাজিক উন্নয়নমূলক কাজে অর্থ ব্যয় করতে পারবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button