আংকারায় এরদোয়ান ও জেলেনস্কির বৈঠক

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ান এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কি আংকারায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেছেন। এই বৈঠকটি এমন একটি সময়ে অনুষ্ঠিত হলো, যখন ইউক্রেন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তার অবস্থান শক্তিশালী করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিচ্ছে। বিশেষত, যখন কিয়েভ যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে চলমান আলোচনার প্রেক্ষিতে নিজেদের কৌশল আরও পরিপক্ব করতে চায়।
বৈঠকের উদ্দেশ্য ও প্রেক্ষাপট
জেলেনস্কি ১৭ ফেব্রুয়ারি রাতে সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) থেকে তুরস্কে পৌঁছান। তিনি টেলিগ্রামে তার সফর সম্পর্কিত তথ্য প্রদান করে জানান যে, তিনি এরদোয়ানের সঙ্গে বন্দি বিনিময়সহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন। উল্লেখযোগ্য যে, গত মার্চে তুরস্কে সফর করেছিলেন জেলেনস্কি, এবং বর্তমানে তার সৌদি আরব সফরের প্রস্তুতি চলছে। এই সফর ইউক্রেনের যুদ্ধ পরিস্থিতি এবং আন্তর্জাতিক কূটনীতি নিয়ে নতুন দৃষ্টিকোণ সৃষ্টি করতে পারে।
এরদোয়ান এবং জেলেনস্কির মধ্যে আলোচনা মূলত দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার ক্ষেত্রে আরও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের ওপর কেন্দ্রীভূত ছিল। তুরস্ক, যা ন্যাটো সদস্য দেশ, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করছে, সেই অবস্থান থেকে একাধিক শান্তির উদ্যোগে অংশগ্রহণ করে আসছে। এরদোয়ান নিজেকে এক সম্ভাব্য মধ্যস্থতাকারী হিসেবে উপস্থাপন করেছেন, যার মাধ্যমে তিনি ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাতের সমাধানে সাহায্য করতে চান।
বন্দি বিনিময় এবং তুরস্কের মধ্যস্থতা
তুরস্কের এক শীর্ষ সহযোগী ফাহরেত্তিন আলতুন জানিয়েছেন, দুই নেতা তাদের দেশগুলির মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করার উপায় নিয়ে আলোচনা করেছেন। বিশেষত, তুরস্ক রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে বেশ কয়েকটি বন্দি বিনিময় চুক্তির মধ্যস্থতা করেছে, যা শত শত বন্দির মুক্তি নিশ্চিত করেছে। যুদ্ধ চললেও, এসব চুক্তি অনেক ব্যক্তির জীবন বাঁচিয়েছে এবং তাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার পথ উন্মুক্ত করেছে।
এছাড়াও, তুরস্ক ইউক্রেনকে ড্রোন সরবরাহ করলেও মস্কোর বিরুদ্ধে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাগুলি কার্যকর করতে অস্বীকার করেছে। এর ফলে তুরস্কের পক্ষ থেকে একটি নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করা হয়েছে, যা তার আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক প্রভাবকে আরও শক্তিশালী করে। এই বৈঠকের মাধ্যমে উভয় দেশ একে অপরকে আরও কাছাকাছি আনতে এবং সহযোগিতার ক্ষেত্র উন্নত করতে চাইছে।
আন্তর্জাতিক কূটনীতি এবং আলোচনার নতুন সুযোগ
তুরস্ক ও ইউক্রেনের শীর্ষ নেতৃত্বের বৈঠকটি এমন একটি সময়ে অনুষ্ঠিত হলো, যখন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার কূটনীতিকরা সৌদি আরবে তাদের প্রথম উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক করেছেন। এই বৈঠকটি ছিল ২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর তাদের প্রথম মুখোমুখি সাক্ষাৎ। এটি আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক চিত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে গণ্য হচ্ছে।
এমন প্রেক্ষাপটে, তুরস্ক ও ইউক্রেনের মধ্যকার আলোচনা একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশেষত, যেখানে জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা ইউক্রেনের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন, সেখানে তুরস্কের মধ্যস্থতার ভূমিকা আরো গুরুত্ব পেতে পারে।
সম্ভাব্য শান্তি প্রক্রিয়া এবং ইউক্রেনের ভবিষ্যত
জেলেনস্কির বক্তব্য অনুযায়ী, ইউক্রেন শান্তি প্রক্রিয়ার জন্য যে সম্ভাব্য আলোচনার টেবিল প্রস্তুত করছে, তাতে তুরস্কের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। বিশেষত, তুরস্ক এবং ইউক্রেনের মধ্যে সম্পর্ক জোরদারের পাশাপাশি তুরস্ক ইউক্রেনের সহায়তায় আরও কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। তবে ইউক্রেনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, তার সুরক্ষা এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষা করা।
এদিকে, মার্কিন এবং রুশ কর্মকর্তারা তাদের দুই নেতার মধ্যে শীর্ষ সম্মেলন আয়োজনের পরিকল্পনা করছেন, যা ইউক্রেন ও ইউরোপীয় দেশগুলোর জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের আশঙ্কা, যে কোনো শান্তি আলোচনা হয়তো তাদের বাদ দিয়েই হতে পারে, যা ইউক্রেন এবং তার পাশ্ববর্তী দেশের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।
সাউথ ইউরোপীয় ভূমিকা
এই বৈঠকের মাধ্যমে তুরস্কের মধ্যস্থতা আরও প্রমাণিত হলো যে, তারা আন্তর্জাতিক সংঘাতের সমাধানে এককভাবে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে প্রস্তুত। তুরস্ক, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলো মাঝেমাঝে এমন উদ্যোগ নিয়ে থাকে, যা রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে সহায়ক হতে পারে।
উপসংহার
আংকারায় এরদোয়ান ও জেলেনস্কির বৈঠকটি শুধু দুটি দেশের সম্পর্কের ওপরই গুরুত্ব দেয় না, বরং এটি আন্তর্জাতিক কূটনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। তুরস্কের শান্তির উদ্যোগ এবং কূটনৈতিক সমাধান উদ্দীপনা হিসেবে কাজ করতে পারে, যা পরবর্তীতে ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাতের সমাধান প্রক্রিয়াকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়ক হবে।