প্রিমিয়ার ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করলেন এইচ বি এম ইকবাল

আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য হেফজুল বারী মোহাম্মদ ইকবাল (এইচ বি এম ইকবাল) প্রিমিয়ার ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে তিনি দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে এই পদে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। একইসঙ্গে ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান ও তাঁর পুত্র মঈন ইকবালও দায়িত্ব ছেড়েছেন। তাঁরা দুজনেই পরিচালক পদ থেকেও পদত্যাগ করেছেন।
পদত্যাগের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা
ব্যাংক-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি তাঁরা আনুষ্ঠানিকভাবে পদত্যাগপত্র জমা দেন এবং ১৪ জানুয়ারি পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে তা অনুমোদিত হয়। একই সময়ে ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক কাইজার এ চৌধুরীও পদত্যাগ করেন।
এইচ বি এম ইকবাল স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করলেও মঈন ইকবাল কোনো কারণ উল্লেখ না করেই পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। তবে ব্যাংকের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে এখনো তাঁদের নাম পরিচালনা পর্ষদের তালিকায় রয়েছে।
নতুন নেতৃত্বে ইমরান ইকবাল
এইচ বি এম ইকবালের পদত্যাগের পর ব্যাংকের নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁর আরেক ছেলে ইমরান ইকবালকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ইমরান ইকবাল এর আগে ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
ব্যাংকের সঙ্কট ও দুর্নীতির অভিযোগ
প্রিমিয়ার ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে নানা আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে আলোচিত। বিশেষ করে ২০২৪ সালের শেষ দিকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এইচ বি এম ইকবাল ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে জালিয়াতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও ঋণের নামে অর্থ আত্মসাতের তদন্ত শুরু করে।
গত অক্টোবর মাসে দুদকের আবেদনের ভিত্তিতে আদালত এইচ বি এম ইকবাল ও তাঁর স্ত্রী আঞ্জুমান আরা শিল্পীর বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এরপর নভেম্বর মাসে এইচ বি এম ইকবাল, তাঁর স্ত্রী ও তাঁদের তিন সন্তানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়। তাঁদের তিন সন্তান হলেন—মঈন উদ্দিন ইকবাল, ইকরাম ইকবাল ও নওরীন ইকবাল। এই সন্তানদের মধ্যে মঈন ও ইকরাম ছিলেন প্রিমিয়ার ব্যাংকের পরিচালক।
ক্ষমতার অপব্যবহার ও ব্যবসায়িক আধিপত্য
এইচ বি এম ইকবাল শুধু প্রিমিয়ার ব্যাংকের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, তিনি ছিলেন প্রিমিয়ার গ্রুপের চেয়ারম্যান। তাঁর মালিকানাধীন গ্রুপটির অধীনে পাঁচ তারকা হোটেল, রেস্টুরেন্ট, সিমেন্ট উৎপাদন, মেডিকেল সেন্টারসহ বিভিন্ন খাতের ব্যবসা পরিচালিত হতো।
বিশ্লেষকদের মতে, দীর্ঘ সময় প্রিমিয়ার ব্যাংকের নেতৃত্বে থেকে তিনি ব্যাংকটির বিভিন্ন কার্যক্রমের ওপর একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এর ফলে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের ওপর তাঁর পরিবারের নিয়ন্ত্রণ বাড়তে থাকে। তবে সাম্প্রতিক দুর্নীতির অভিযোগের ফলে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদেও ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে।
ব্যাংকের ভবিষ্যৎ ও আর্থিক অবস্থা
এইচ বি এম ইকবালের পদত্যাগের পর ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার বিষয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে ব্যাংকের শেয়ারের মূল্য সাম্প্রতিক সময়ে ওঠানামা করছে।
ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “পরিচালনা পর্ষদের পরিবর্তন ব্যাংকের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। নতুন নেতৃত্ব কিভাবে ব্যাংক পরিচালনা করবে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।”
এ বিষয়ে জানতে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আবু জাফরকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও আইনি প্রভাব
এইচ বি এম ইকবালের পদত্যাগ ও দুর্নীতির অভিযোগ রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গেও সম্পর্কিত বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে তিনি দেশত্যাগ করেন। তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন দুর্নীতির তদন্ত শুরু হলে তাঁর পরিবারের সদস্যদেরও আইনি জটিলতায় পড়তে হয়।
এখন দেখার বিষয়, নতুন নেতৃত্বের অধীনে প্রিমিয়ার ব্যাংক কীভাবে সামনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে পারবে কি না।