অর্থনীতি

বিশ্ববাজারে কমতে শুরু করেছে জ্বালানি তেলের দাম

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ক্রমশ কমতে শুরু করেছে। ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে সম্ভাব্য শান্তি চুক্তির ইঙ্গিত পাওয়ার পর বাজারে এই পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম সাম্প্রতিক সময়ে উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে, যা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।

বাজার পরিস্থিতি ও সাম্প্রতিক মূল্য পরিবর্তন

বৃহস্পতিবার ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ব্যারেলপ্রতি ৮১ সেন্ট বা ১.১% কমে ৭৪.৩৭ ডলারে নেমে এসেছে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের বেঞ্চমার্ক ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট (WTI) অপরিশোধিত তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ৮১ সেন্ট বা ১.১% কমে ৭০.৫৬ ডলারে দাঁড়িয়েছে। এর আগে বুধবার, উভয় বেঞ্চমার্ক তেলের মূল্য দুই শতাংশ হ্রাস পেয়েছিল।

বিশ্লেষকদের মতে, সাম্প্রতিক এই মূল্য হ্রাসের প্রধান কারণ রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে শান্তি আলোচনার অগ্রগতি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে ফোনালাপে এই আলোচনা দ্রুত এগিয়ে নেওয়ার ইঙ্গিত দেন।

শান্তি আলোচনার সম্ভাবনা ও মার্কিন প্রশাসনের অবস্থান

মার্কিন প্রশাসনের সূত্র জানিয়েছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার উপদেষ্টাদের স্পষ্ট করে জানিয়েছেন যে, ইউক্রেন যুদ্ধের দ্রুত অবসান তার অন্যতম লক্ষ্য। সম্প্রতি ট্রাম্প প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা ইউক্রেন যুদ্ধের সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে আলোচনাও শুরু করেছেন।

ট্রাম্প এবং পুতিনের মধ্যে এক দেড় ঘণ্টার ফোনালাপের পর, হোয়াইট হাউস জানায় যে ইউক্রেন সংকট নিরসনে তাৎক্ষণিক আলোচনা শুরু হতে পারে। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ ব্রাসেলসে এক সম্মেলনে বলেন, “কিয়েভের জন্য ন্যাটোতে যোগদান এখন বাস্তবসম্মত নয়। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান নীতি ইউরোপ ও ইউক্রেনের নিরাপত্তার চেয়ে নিজ দেশের সীমানা রক্ষা এবং চীনের সঙ্গে উত্তেজনা প্রশমনের ওপর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।”

রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব

রাশিয়া বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম তেল উৎপাদনকারী দেশ। ২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার অপরিশোধিত তেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, যার ফলে জ্বালানি তেলের দাম বিশ্ববাজারে ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়।

বিশ্লেষকরা বলছেন, রাশিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা কিছুটা শিথিল করা হলে বাজারে আরও মূল্য হ্রাস হতে পারে। ইউক্রেনের সংঘাতের অবসান হলে রাশিয়া তার তেল রপ্তানি বাড়াতে পারবে, যা সরবরাহ বৃদ্ধির মাধ্যমে বিশ্ববাজারের স্থিতিশীলতা আনতে পারে।

বিশ্ব অর্থনীতিতে সম্ভাব্য প্রভাব

জ্বালানি তেলের দাম হ্রাস বিশ্ব অর্থনীতির জন্য মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে।

  1. উপভোক্তাদের জন্য ইতিবাচক প্রভাব: তেলের দাম কমলে জ্বালানির খরচ হ্রাস পাবে, যা সাধারণ ভোক্তাদের জন্য স্বস্তিদায়ক হতে পারে। পরিবহন খরচ কমে গেলে খাদ্যপণ্য ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দামও কমতে পারে।
  2. তেল উৎপাদক দেশগুলোর জন্য নেতিবাচক প্রভাব: মধ্যপ্রাচ্য, রাশিয়া, এবং যুক্তরাষ্ট্রের শেল তেল উৎপাদকদের জন্য এই মূল্য হ্রাস আর্থিক ক্ষতির কারণ হতে পারে। বিশেষ করে সৌদি আরব এবং রাশিয়ার মতো দেশগুলোর অর্থনীতি তেল রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল।
  3. বিনিয়োগকারীদের প্রতিক্রিয়া: বিনিয়োগকারীরা এই পরিস্থিতিতে সতর্ক অবস্থান নিতে পারেন। অনেকেই অস্থির বাজারে বিনিয়োগের ঝুঁকি কমাতে চান, ফলে পুঁজিবাজারে কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

ভবিষ্যৎ প্রবণতা ও বিশ্লেষকদের পূর্বাভাস

বিশ্লেষকদের মতে, সামনের দিনগুলোতে তেলের দাম আরও কমতে পারে যদি রাশিয়া-ইউক্রেন শান্তি আলোচনা ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনে। তবে, এই প্রবণতা দীর্ঘস্থায়ী হবে কি না, তা নির্ভর করবে ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর।

বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল রপ্তানিকারক দেশ সৌদি আরব এবং ওপেক (OPEC) সদস্যরা বাজার স্থিতিশীল রাখতে উত্পাদন হ্রাসের মতো পদক্ষেপ নিতে পারেন। ওপেক ও তার সহযোগী দেশগুলোর পরবর্তী বৈঠকে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে।

তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং অন্যান্য বৃহৎ তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর নীতিগত পরিবর্তন এবং বাজারের চাহিদা-সরবরাহের ভারসাম্যও ভবিষ্যতের দামের ওপর প্রভাব ফেলবে।

উপসংহার

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ইঙ্গিত বহন করে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের সম্ভাব্য সমাপ্তি, মার্কিন প্রশাসনের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং ওপেকের প্রতিক্রিয়া—এসব বিষয় আগামী দিনে তেলের দামের গতিপথ নির্ধারণ করবে। সাধারণ জনগণের জন্য এটি স্বস্তিদায়ক হলেও, তেল উৎপাদক দেশগুলোর জন্য এটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button