শতাধিক দেশের অংশগ্রহণে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্মেলন

প্যারিস, ফ্রান্স: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং এর সম্ভাব্য ঝুঁকি মোকাবিলায় বিশ্বের শতাধিক দেশ প্যারিসে এক সম্মেলনে অংশ নিয়েছে। গত মাসে চীনের ডিপসিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বকে বড় চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে, যা প্রযুক্তি ও কূটনৈতিক মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এই প্রেক্ষাপটে দুই দিনের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিশ্বনেতারা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সম্ভাবনা ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আলোচনা করছেন।
সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা
সোমবার থেকে শুরু হওয়া এই সম্মেলনে উপস্থিত রয়েছেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স, যিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথমবারের মতো বিদেশ সফরে এসেছেন। চীনের উপপ্রধানমন্ত্রী ঝাং গুওকিংও রয়েছেন আমন্ত্রিত অতিথিদের তালিকায়। এছাড়াও, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতি এই সম্মেলনকে আরও তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ এই সম্মেলনের অন্যতম প্রধান আয়োজক, যিনি মনে করেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উন্নত জীবনযাপন, শিক্ষার উন্নতি, দক্ষতা বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্যসেবায় ব্যাপক পরিবর্তন আনতে সক্ষম।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভবিষ্যৎ: প্রযুক্তির সম্ভাবনা বনাম ঝুঁকি
ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রোঁ দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন চ্যানেল ফ্রান্স টু-তে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমরা এমন এক প্রযুক্তিগত ও বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, যা ইতিহাসে বিরল।” তিনি উল্লেখ করেন, ফ্রান্স এবং ইউরোপের দেশগুলোকে এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে নিজেদের প্রযুক্তিগত অবস্থান সুদৃঢ় করতে হবে।
এদিকে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সম্ভাবনার পাশাপাশি এর ঝুঁকির বিষয়টিও আলোচনায় গুরুত্ব পাচ্ছে। ২০২২ সালে চ্যাটজিপিটি ভাইরাল হওয়ার পর থেকে এআই নিয়ন্ত্রণ এবং এর সম্ভাব্য ক্ষতিকর দিক নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনার ঝড় উঠে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, নিয়ন্ত্রণবিহীন এআই প্রযুক্তি সাইবার নিরাপত্তা, তথ্যের গোপনীয়তা এবং বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন ধরনের সংকট তৈরি করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি: কূটনৈতিক আলোচনা ও নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা
মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ভ্যান্স এই সম্মেলনের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেন, “এআই শীর্ষ সম্মেলনে যাওয়ার প্রধান কারণ হলো যেসব বিশ্ব নেতা সেখানে থাকবেন, তাদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগত আলোচনার সুযোগ পাওয়া। আমি মনে করি, এই সম্মেলনে উপস্থিত কয়েকজন নেতা রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের সমাধানে কূটনৈতিকভাবে ভূমিকা রাখতে পারেন। তাই আমরা ফ্রান্সে এসব বৈঠকে মনোনিবেশ করবো।”
মার্কিন প্রশাসন দীর্ঘদিন ধরে এআই-এর বিকাশে বিনিয়োগ করে আসছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ফলে যুক্তরাষ্ট্র এআই নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা বাড়ানোর ওপর বিশেষ জোর দিচ্ছে।
চীনের অবস্থান: প্রযুক্তি প্রতিযোগিতার নতুন দিগন্ত
চীন বর্তমানে এআই গবেষণা ও উন্নয়নে অন্যতম প্রধান দেশ হিসেবে উঠে এসেছে। দেশটির উপপ্রধানমন্ত্রী ঝাং গুওকিং সম্মেলনে চীনের প্রযুক্তিগত অর্জন এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরবেন বলে জানা গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এআই-ভিত্তিক প্রতিযোগিতা ভবিষ্যতে বৈশ্বিক প্রযুক্তি খাতে নতুন উত্তেজনার সৃষ্টি করতে পারে।
ইউরোপের কৌশল: স্বাধীন নীতিমালা ও গবেষণা সম্প্রসারণ
ইউরোপীয় দেশগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশ এবং নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে স্বাধীন নীতিমালা গড়ে তোলার পরিকল্পনা করছে। ফ্রান্স ও জার্মানির মতো দেশগুলো চাচ্ছে, ইউরোপ নিজস্ব প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়িয়ে এআই গবেষণায় নেতৃত্বের অবস্থান তৈরি করুক।
নিয়ন্ত্রণ ও নৈতিক দিক: ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
বিশ্বনেতাদের আলোচনার অন্যতম প্রধান বিষয় হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নিয়ন্ত্রণ ও এর নৈতিক ব্যবহার নিশ্চিত করা। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভুলভাবে ব্যবহৃত হলে এআই বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
বিভিন্ন দেশ এআই-এর জন্য নতুন আইনি কাঠামো ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তৈরির উদ্যোগ নিচ্ছে। এআই গবেষণার জন্য নৈতিক নির্দেশিকা ও স্বচ্ছ নীতিমালা তৈরির প্রস্তাবও উঠেছে এই সম্মেলনে।
উপসংহার
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ যেমন রয়েছে, তেমনি এর সম্ভাবনার দিকও অসীম। প্যারিসের এই সম্মেলন এআই-এর ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশ্বনেতারা যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ঝুঁকি ও সম্ভাবনা নিয়ে কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, তাহলে এটি মানব সভ্যতার জন্য এক যুগান্তকারী পরিবর্তন বয়ে আনবে।