কক্সবাজারের টেকনাফে জন্মদিনকে ঘিরে তৈরি হলো এক অদ্ভুত, বিপজ্জনক এবং বিতর্কিত আয়োজন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জন্য “ভাইরাল ভিডিও” বানানোর উদ্দেশ্যে ব্যাডমিন্টন কোর্টের মাঝখানে আগুনের মশাল জ্বালিয়ে, চারপাশে দাহ্যবস্তু ছড়িয়ে এবং নিজের দামি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে ফেললেন শাহ আজম নামে এক যুবক। ঘটনাটি দ্রুত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্যপক সমালোচনার জন্ম দেয়।
ঘটনাটি ঘটেছে রোববার (৭ ডিসেম্বর) রাতে, টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের একটি কোর্টে। ভিডিওতে দেখা যায়—এক ব্যক্তি মোটরসাইকেলের উপর পেট্রোল ঢালছেন, আর পাশে আগুনের মশাল হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন জন্মদিনের উদ্যোক্তা শাহ আজম। মুহূর্তের মধ্যেই দাহ্যবস্তুতে আগুন ধরে চারপাশ লাল হয়ে যায়। কোর্টের কেন্দ্রস্থলে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে মোটরসাইকেলটি।
সৌভাগ্যবশত, আগুন ছড়িয়ে পড়ার আগেই সবাই নিরাপদে সরে যেতে পেরেছিলেন।
কে এই শাহ আজম?
শাহ আজম স্থানীয়ভাবে ‘আজম সরকার’ নামে পরিচিত। তিনি হ্নীলা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মোহাম্মদ জামাল হোসেনের ছেলে।
২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি টেকনাফে আলোচিত ১০২ জন মাদক কারবারি যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন, শাহ আজম ছিলেন তাদের একজন। পরবর্তীতে প্রায় দুই বছরের কারাবাস শেষ করে তিনি মুক্তি পান। কিন্তু কিছুদিন পরই ২০২১ সালের ২৩ মে এক লাখ ইয়াবাসহ তিনি আবারও গ্রেপ্তার হন—যা তাকে আবার নতুন করে আলোচনায় আনে।
এরপর থেকেই তিনি নিজের জীবনে পরিবর্তন আনার দাবি করতে থাকেন এবং ফেসবুকে মানবিক কর্মকাণ্ড, অসহায় মানুষের সাহায্য ও ব্যক্তিগত নানা কাজের ভিডিও প্রচার করে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ফেসবুকে তার অনুসারীর সংখ্যা ১ লাখ ২৪ হাজার, ইউটিউবে কয়েক হাজার সাবস্ক্রাইবারও রয়েছে।
জন্মদিনের আগুন—এক ভিডিওর গল্প
ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়—সেলিম নামে এক ব্যক্তি মোটরসাইকেলে পেট্রোল ঢালছেন, আর শাহ আজম আগুন ধরানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আগুন ধরতেই পুরো ব্যাডমিন্টন কোর্টের চারপাশে আগুনের দেয়াল তৈরি হয়।
কিছু যুবক পরে পানি ও বালি নিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। একই সঙ্গে জন্মদিন উপলক্ষে কোর্টে আগুন দিয়ে বড় করে লেখা হয়—“Thirty Years”।
এই অংশটিই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। কারণ কোথাও ব্যবহৃত হয়নি কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা—না আছে অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র, না আগুন নিয়ন্ত্রণের দল।
শাহ আজমের ব্যাখ্যা—“ভুলক্রমে আগুন লেগেছে”
ঘটনা ছড়িয়ে পড়ার পর আরও একটি ভিডিও বার্তায় শাহ আজম দাবি করেন—
“ভুলবশত এই আগুন লেগেছে। ভিডিও দেখে কেউ যেন এমন ঝুঁকিপূর্ণ ট্রেন্ড অনুসরণ না করে—এই অনুরোধ করছি।”
তবে ভিডিওর প্রস্তুতি, পেট্রোল ঢালা, মশাল হাতে আগুন ধরানো—সবই যে পরিকল্পিত, সেটি স্পষ্ট। ফলে তার মন্তব্যে আরও বিতর্ক সৃষ্টি হয়।
ভিডিও ধারণে কার ভূমিকা?
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বেলাল হোসেন নামে একজন কন্টেন্ট ক্রিয়েটর ‘থটস অফ বিল্লাল’ নামে একটি সোশ্যাল মিডিয়া পেজের জন্য এই ভিডিও ধারণ করছিলেন।
ঘটনাস্থলে থাকা আরেক কন্টেন্ট ক্রিয়েটর লোকমান বলেন—
“বিল্লাল এবং তার দল মিথ্যা ভাইরাল ভিডিও বানায়। এসব বানাতে গিয়ে নিজেরাই জীবন ঝুঁকির মধ্যে থাকে। এবার শাহ আজম, বেলাল আর সেলিম প্রায় প্রাণ হারাতে বসেছিল। আল্লাহর রহমতে তারা বেঁচে গেছে।”
সোশ্যাল মিডিয়ার ট্রেন্ড—কেন এত বিপজ্জনক হয়ে উঠছে?
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটককে কেন্দ্র করে কন্টেন্ট তৈরির প্রবণতা বেড়েছে। জনপ্রিয়তা, ফলোয়ার, আয়—এসবের লোভে অনেকে বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।
আগে ছিল গানের ভিডিও, কমেডি, নাচ—কিন্তু এখন এগুলো ছাপিয়ে যাচ্ছে চরম স্টান্ট, আগুনের ভিডিও, উঁচু স্থান থেকে লাফ, বিপজ্জনক মোটরসাইকেল রাইড, নাইজেরিয়ান স্টাইল ট্রেন্ডিং শুট ইত্যাদি।
বিশেষ করে আগুন দিয়ে লেখা বানানো, গাড়িতে আগুন ধরা, গ্যাস সিলিন্ডার ফাটানোর মতো ভিডিওও এখন ট্রেন্ডিং—যা জীবনহানির ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
ফায়ার সার্ভিসের বক্তব্য—“এটা স্পষ্ট অপরাধ”
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কক্সবাজারের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন—
“প্রকাশ্যে দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করে আগুন লাগানো সম্পূর্ণ অবৈধ এবং অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইনের লঙ্ঘন। শীতকালে আগুনের মাত্রা দ্রুত ছড়াতে পারে। এতে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটলে বহু মানুষের জীবন ঝুঁকির মুখে পড়ত।”
আবারও আলোচনায় আসে কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের নিরাপত্তাহীনতা
টেকনাফের এই ভিডিওর সাথে সাথে মনে পড়তে থাকে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া আরেকটি মর্মান্তিক ঘটনাকে।
২৮ নভেম্বর, ময়মনসিংহের গৌরীপুরের দাড়িয়াপুর ইটখোলায় জনপ্রিয় কন্টেন্ট ক্রিয়েটর আল আমিন শীতকালীন থিমের ভিডিও বানাতে গিয়ে আগুনে গুরুতর দগ্ধ হন।
তিনি এখনো ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (BUP)-এর মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের একজন অধ্যাপক বলেন—
“ডিজিটাল মিডিয়ার প্রতিযোগিতা মানুষকে অস্বাস্থ্যকর পথে ঠেলে দিচ্ছে। ভাইরাল হওয়ার প্রবণতা এখন মানসিক আসক্তিতে পরিণত হয়েছে। এতে সমাজে ভুল বার্তা ছড়ায়, তরুণেরা অনুকরণ করতে গিয়ে বিপদের মুখে পড়ে।”
একজন মনোবিজ্ঞানী বলেন—
“ফলোয়ার বাড়ানো ও জনপ্রিয়তার নেশা অনেক সময় ঝুঁকি বিবেচনা করার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এটি ‘ডোপামিন-ড্রিভেন অ্যাডিকশন’। এর জন্য প্রয়োজন সচেতনতা, প্রশিক্ষণ ও ডিজিটাল লিটারেসি।”
আইনগত জটিলতা—কী হতে পারে?
অগ্নিনির্বাপন আইনের পাশাপাশি আরও যে ধারায় মামলা হতে পারে—
- জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি
- পরিকল্পিত আগুন লাগানো
- সরকারি সম্পত্তি থাকলে ভাঙচুর
- স্থানীয় নিরাপত্তা ঝুঁকির সৃষ্টি
- দাহ্য পদার্থ অবৈধ ব্যবহার
তাছাড়া শাহ আজমের অতীত ইতিহাস বিবেচনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এই ঘটনাকে গুরুত্বসহকারে দেখছে।
স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া
স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন—
“একজন সাবেক মাদক কারবারি এখন সমাজে ভালো কাজ করে বলেই পরিচিত। কিন্তু এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ ভিডিও তার ভাবমূর্তি নষ্ট করছে এবং সমাজে খারাপ বার্তা দিচ্ছে।”
কেউ কেউ মনে করেন—
“ফলোয়ার বাড়াতে গিয়ে যে ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলো ঘটছে, তা রোধে প্রশাসনকে আরও কঠোর হতে হবে।”
সোশ্যাল মিডিয়া—আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ?
এই ধরনের ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—
- ইন্টারনেট স্বাধীনতা আছে, কিন্তু তার সীমা আছে
- বিনোদন ভালো, কিন্তু জীবনের ঝুঁকি নেওয়া নয়
- কন্টেন্ট তৈরির পেছনে সঠিক পরিকল্পনা, নিরাপত্তা, আইন মেনে চলা জরুরি
বিশেষ করে ইউটিউব এবং ফেসবুকের অ্যালগরিদম যেমন দ্রুত ঝুঁকিপূর্ণ ভিডিও ভাইরাল করে দেয়, ফলে তরুণেরা সেগুলোকে সহজে নকল করে। এর ফলে বাড়ছে দুর্ঘটনা, অগ্নিদগ্ধ, আহত হওয়া এমনকি প্রাণহানিরটিও ঝুঁকি।
সচেতনতা জরুরি—কারণ জীবন একটাই
টেকনাফের এই ঘটনা হয়তো কোনো প্রাণহানি ঘটায়নি। কিন্তু একই ধরনের ঘটনা সামনে বড় বিপদ হয়ে দেখা দিতে পারে।
তাই বিশেষজ্ঞরা বলছেন—
- নিরাপত্তাহীন কন্টেন্ট তৈরির অপরাধ মানে শুধু আইন ভঙ্গ নয়
- এটি নিজের ও অন্যের জীবনের ঝুঁকি সৃষ্টি
- সোশ্যাল মিডিয়া ট্রেন্ড অনুসরণে নিরাপত্তা বিধি মানা বাধ্যতামূলক
- কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের জন্য প্রশিক্ষণ প্রয়োজন
পাশাপাশি সমাজে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন—যাতে মানুষ “ভিউস” ও “ফলোয়ার” এর বিনিময়ে নিজের জীবনকে হুমকির মুখে না ফেলে।
টেকনাফের ঘটনা শুধু একটি জন্মদিন উদযাপনের গল্প নয়।
এটি সোশ্যাল মিডিয়া সংস্কৃতির অন্ধ প্রতিযোগিতার এক জ্বলজ্বলে উদাহরণ, যেখানে “কনটেন্ট” নামের শব্দটির কাছে নিরাপত্তা, বিবেক, আইন—সবকিছুই যেন হার মানে।
কর্তৃপক্ষ যদি এখনই কঠোর না হয়, সচেতনতা না বাড়ানো হয়, তবে এমন বিপজ্জনক ভিডিও বানানোর প্রবণতা ভবিষ্যতে আরও বড় দুর্ঘটনার দিকে নিয়ে যেতে পারে।
MAH – 14190 I Signalbd.com



