পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ঘিরে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস. জয়শঙ্কর সম্প্রতি দেওয়া মন্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে ইসলামাবাদ। পাকিস্তান বলেছে, ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এখন ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠীর প্রভাব ও চাপে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, যা শুধু দুই প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ককেই নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা পরিবেশকেই অস্থির করে তুলেছে।
৭ ডিসেম্বর দেওয়া এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র তাহির আন্দ্রাবি বলেন—
“জয়শঙ্করের মন্তব্য অত্যন্ত পীড়াদায়ক, ভিত্তিহীন, বিভ্রান্তিকর ও দায়িত্বজ্ঞানহীন। ভারতীয় রাষ্ট্র এবং এর নেতৃত্ব উভয়ই ধর্মের নামে সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে।”
তার এই মন্তব্য শুধু ভারতের সাম্প্রতিক রাজনীতি নয়, বরং চলমান ক্ষমতাসীন নেতৃত্বের নীতি ও দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতির ভবিষ্যৎ—সব কিছুই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
জয়শঙ্করের বক্তব্য: কী বলেছেন তিনি?
৬ ডিসেম্বর নয়াদিল্লিতে এক সম্মেলনে বক্তব্য দিতে গিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেন—
- “পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের বেশিরভাগ সমস্যার মূল কারণ হলো পাকিস্তানি সেনাবাহিনী।”
- “পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ভারতের বিরুদ্ধে শত্রুতা বজায় রাখছে এবং দুই দেশের সম্পর্ক বাধাগ্রস্ত করছে।”
জয়শঙ্কর মনে করেন, পাকিস্তানের বেসামরিক রাজনৈতিক নেতৃত্ব নয়, বরং সামরিক নেতৃত্বই নীতিনির্ধারণে প্রধান ভূমিকা রাখে। এর ফলে স্থিতিশীল সম্পর্ক গড়ে ওঠে না।
পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া: ‘যুদ্ধ নয়, সংলাপ চাই’
পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র তাহির আন্দ্রাবি জবাবে বলেন—
- “পাকিস্তান শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, সংলাপ এবং কূটনীতিতে বিশ্বাস করে।”
- “কিন্তু জাতীয় স্বার্থ, সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় পাকিস্তানের জনগণ ও প্রতিষ্ঠানসমূহ ঐক্যবদ্ধ, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও প্রস্তুত।”
তিনি আরও বলেন,
“ভারতীয় নেতৃত্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং সেনাবাহিনীকে হেয় করার অপপ্রচারে লিপ্ত। এটি প্রমাণ করে, ভারত এই অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা চায় না।”
মে মাসের সংঘর্ষকে তুলে ধরল পাকিস্তান
তাহির আন্দ্রাবি জানান, গত মে মাসে সীমান্ত এলাকায় যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল, তা পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর পেশাদারিত্ব ও দায়িত্বশীল আচরণ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
তার ভাষায়—
“মে মাসের সংঘর্ষ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পেশাদারিত্ব এবং মাতৃভূমি রক্ষায় তাদের দৃঢ় অবস্থানের প্রমাণ।”
ইসলামাবাদ বলছে, ভারতীয় আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান কখনোই উত্তেজনা বাড়াতে আগ্রহী নয়। বরং চাপ সৃষ্টি করা হলে তারা প্রতিরক্ষার দায়িত্বই পালন করেছে।
দুই দেশের দীর্ঘদিনের উত্তেজনা – ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
ভারত–পাকিস্তান সম্পর্ক বহু দশক ধরেই জটিল। বিশেষজ্ঞদের মতে, জয়শঙ্কর ও পাকিস্তান সরকারের সাম্প্রতিক কথার লড়াই কেবল একটি নতুন অধ্যায়; মূল সংকট আরও গভীরে।
১. কাশ্মীর ইস্যু
গত শতকের মাঝামাঝি থেকে আজ পর্যন্ত দুই দেশের সম্পর্কের প্রধান অস্থিরতার কেন্দ্র কাশ্মীর।
- ভারত দাবী করে, জম্মু–কাশ্মীর তার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
- পাকিস্তানের মতে, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই অঞ্চল জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার রাখে।
২০১৯ সালে ভারতের সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিলের পর পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। পাকিস্তান এটিকে ‘একতরফা ও বেআইনি’ বলে দাবি করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিবাদ জানায়।
২. সীমান্তে সংঘর্ষ – ব্যাক-টু-ব্যাক উত্তেজনা
গত কয়েক বছরে লাইন অব কন্ট্রোল (LoC) এবং আন্তর্জাতিক সীমান্তে দুই দেশের বাহিনীর মধ্যে বেশ কয়েকবার উত্তেজনা দেখা দিয়েছে।
- গুলিবিনিময়
- বিমান হামলার হুমকি
- গোয়েন্দা তথ্য নিয়ে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ
পাকিস্তানের মতে, ভারত ইচ্ছাকৃতভাবে সীমান্তে উত্তেজনা তৈরি করে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করে।
৩. সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ এবং পরস্পরের অভিযোগ
ভারত দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ করে আসছে যে পাকিস্তান সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে আশ্রয় দেয়।
অন্যদিকে পাকিস্তানের দাবি—
- ভারত কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে
- মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর অত্যাচার করছে
- এবং আঞ্চলিক রাজনীতিকে সামরিকীকরণ করছে
এমন পরিস্থিতিতে দুই দেশের মধ্যে বিশ্বাসের সংকট গভীরতর হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ: কেন উত্তেজনা বাড়ছে?
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন—
১. অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক প্রভাব
ভারতের বর্তমান রাজনৈতিক পরিবেশে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ বড় ভূমিকা রাখছে।
পাকিস্তান সেই বিষয়টি এবার স্পষ্টভাবে তুলেছে।
২. আঞ্চলিক শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতা
দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে ভারত ও পাকিস্তান বহু বছর ধরেই প্রতিযোগিতায় আছে।
- চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠতা
- যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক
- আফগানিস্তানের রাজনৈতিক পরিবর্তন
সবই সম্পর্কের জটিলতা বাড়িয়েছে।
৩. তথ্যযুদ্ধ (Information Warfare)
উভয় দেশই এখন গণমাধ্যম, আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম, কূটনৈতিক মহল—সব জায়গায় নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে চাইছে।
পাকিস্তানের অভিযোগ—‘‘ভারত ধর্মীয় উগ্রবাদের কাছে নিয়ন্ত্রিত’’
আন্দ্রাবির মন্তব্য—
“ভারতীয় রাষ্ট্র এখন ধর্মীয় রাজনৈতিক শক্তির কাছে জিম্মি।”
অনেক আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকও মনে করেন—
- ভারতের অভ্যন্তরে ধর্মীয় উত্তেজনা বাড়ছে
- সংখ্যালঘুদের ওপর চাপ
- রাজনৈতিক বক্তব্যে উগ্রপন্থী ভাষার ব্যবহার
- কূটনীতিতেও তার প্রভাব
এই পরিস্থিতিতে প্রতিবেশী দেশের অভ্যন্তরীণ নীতি নিয়ে মন্তব্য করা পাকিস্তানের কৌশলের অংশ বলে মনে করা হচ্ছে।
ভারতের অবস্থান: ‘‘পাকিস্তান সন্ত্রাসের উৎস’’
জয়শঙ্কর ও ভারত সরকারের ভাষ্য—
- পাকিস্তান বহু বছর ধরে সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ককে সহায়তা করেছে
- রাষ্ট্রীয় নীতিতেই এদের প্রশ্রয় ছিল
- পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ভারতের বিরুদ্ধে শত্রুতামূলক নীতি চালায়
এ কারনে কথোপকথন ও শান্তি আলোচনাও এগোয় না।
বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি
যুক্তরাষ্ট্র
দুই দেশের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক বজায় রাখলেও যুক্তরাষ্ট্র বারবার বলেছে—
“দুর্বার উত্তেজনা কমাতে উভয় পক্ষকে আলোচনায় ফিরতে হবে।”
চীন
পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র। ভারত–চীন টানাপোড়েনও প্রেক্ষাপটে আছে।
জাতিসংঘ
কাশ্মীর প্রশ্নে সংযম ও মানবাধিকার রক্ষার আহ্বান জানিয়ে আসছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় স্থিতিশীলতা: এখন কী হতে পারে?
বিশ্লেষকদের মতে—
- বর্তমান অবস্থায় উত্তেজনা আরও বাড়তে পারে।
- উভয় দেশ পরস্পরের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সহায়তা লাভে তৎপর হবে।
- সীমান্তে ছোটখাটো সংঘর্ষ বা রাজনৈতিক বাকযুদ্ধ অব্যাহত থাকতে পারে।
- আলোচনায় ফিরতে চাইলে উভয় দেশকেই নমনীয় হতে হবে—যা আপাতত সম্ভাবনা কম।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস. জয়শঙ্করের বক্তব্য এবং পাকিস্তানের কড়া জবাব দক্ষিণ এশিয়ার কূটনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ইসলামাবাদ জানিয়েছে, ভারতীয় নেতৃত্ব “ধর্মীয় সন্ত্রাসের কাছে জিম্মি”, আর নয়াদিল্লির দাবি—“পাকিস্তানের সেনাবাহিনীই দুই দেশের সমস্যার মূল।”
এই বিরোধ শুধু দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক নয়, বরং আঞ্চলিক নিরাপত্তা, রাজনৈতিক স্থিতি এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনের ভূ–রাজনৈতিক সমীকরণেও বড় প্রভাব ফেলতে পারে।
পরিস্থিতি কোথায় গড়ায়—তা নির্ভর করবে উভয় দেশের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও শান্তির পথে এগোনোর মানসিকতার ওপর।
MAH – 14189 I Signalbd.com



