ফুটবল কখনও শুধুই খেলা নয়—এটি মানুষের স্বপ্ন, সংগ্রাম, আবেগ ও অস্তিত্বের প্রতিচ্ছবি। চলমান ফিফা আরব কাপ ২০২৫ যেন সেই কথা আরও একবার প্রমাণ করল। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সিরিয়া ও ফিলিস্তিন জাতীয় ফুটবল দল কোয়ার্টার ফাইনালে জায়গা করে নিয়ে তৈরি করেছে নতুন অধ্যায়।
একদিকে বাশার আল-আসাদের পতনের পর সিরিয়া নতুনভাবে জাতীয় উদযাপনের জন্য প্রস্তুত; অন্যদিকে দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের মাঝে ফিলিস্তিনের জন্য ফুটবলের এই সাফল্য হয়ে উঠেছে এক বিরল আনন্দের মুহূর্ত। আরব বিশ্বের কোটি মানুষের চোখ এখন এই দুই দলের দিকে—যারা ফুটবলের মাধ্যমে দেখিয়েছে ঐক্য, দৃঢ়তা এবং আশার আলো।
গোলশূন্য ড্র, কিন্তু বিশাল অর্জন
৭ ডিসেম্বর কাতারের এডুকেশন সিটি স্টেডিয়ামে ‘গ্রুপ এ’র শেষ ম্যাচে সিরিয়া ও ফিলিস্তিন মুখোমুখি হয়। খেলা গোলশূন্য ড্র হলেও দুই দলের কাছে এটি যেন বিজয়ের চেয়েও বড় কিছু।
‘গ্রুপ এ’-তে দুই দলই সমান ৫ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষে থেকে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছে।
অবাক করার মতো হলেও সত্য—স্বাগতিক কাতার ও তিউনিসিয়া এই পর্যায়েই টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে গেছে।
৪০ হাজার মানুষের উদযাপনে রঙিন স্টেডিয়াম
এডুকেশন সিটি স্টেডিয়ামের প্রায় ৪০ হাজার দর্শক ম্যাচ শেষ হওয়ার আগেই দাঁড়িয়ে নাচতে শুরু করেন।
স্টেডিয়ামের ভিতর আর বাইরে উভয় দেশ থেকেই হাজার হাজার সমর্থক পতাকা হাতে আনন্দে মেতে ওঠে।
খেলা শেষে ফুটবলারদের দেখা যায় একে অপরের সঙ্গে জার্সি বিনিময় করে ছবি তুলতে—যা আরব ফুটবল ইতিহাসে এই ম্যাচটিকে আরও আবেগময় করোয়।
সিরিয়ার দলে উচ্ছ্বাস—‘লিবারেশন ডে’র সঙ্গে আনন্দ দ্বিগুণ
সিরিয়ার স্ট্রাইকার মাহমুদ আল-মাওয়াস ম্যাচ শেষে বলেন:
‘এই ফলাফল আমাদের জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাশার আল-আসাদের পতনের পর যে নতুন সূচনা—তার সঙ্গে এই সাফল্য আরও এক ধাপ এগিয়ে দিল। এখন আমাদের মনোযোগ পুরোপুরি কোয়ার্টার ফাইনালে।’
সিরিয়ার সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তনে জনগণের মধ্যে যে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে, ফুটবল যেন সেই আশারই প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে।
ফিলিস্তিনের জনগণের জন্য “এই জয় এক স্বপ্ন”
ফিলিস্তিন দল শুধু ফুটবল খেলছে না—তারা খেলছে জাতির মর্যাদা রক্ষার লড়াই।
বিশ্বব্যাপী ফিলিস্তিনি সমর্থকদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উচ্ছ্বাসের বন্যা দেখা গেছে।
একজন ফিলিস্তিনি সমর্থক লিখেছেন—
‘এই দিনটি আমাদের জন্য বিজয়ের চেয়েও বড়। আমরা এখনও বেঁচে আছি, লড়ছি, এবং স্বপ্ন দেখতে শিখছি।’
এই ম্যাচ ড্র হলেও এটি ফিলিস্তিনের ফুটবল ইতিহাসে সবচেয়ে স্মরণীয় সাফল্যগুলোর একটি।
আরব কাপ ২০২৫: টুর্নামেন্টের বর্তমান চিত্র
ফিফা আরব কাপ প্রথমবার ২০২১ সালে আলোচনায় আসে। সেই ধারাবাহিকতায় ২০২৫ সালের আসর আরব বিশ্বের ফুটবলকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে।
এ বছরের টুর্নামেন্টের কিছু উল্লেখযোগ্য দিক—
- আধুনিক প্রযুক্তিসহ ৮টি স্টেডিয়ামে আয়োজন
- বিশ্বকাপ–পরবর্তী কাতারের দ্বিতীয় বৃহৎ আন্তর্জাতিক আসর
- আরব বিশ্বে উদীয়মান খেলোয়াড়দের সেরা প্ল্যাটফর্ম
- দর্শকসংখ্যা আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে
সিরিয়া: যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অনবদ্য ঘুরে দাঁড়ানো
গত এক দশকেরও বেশি গৃহযুদ্ধের পর সিরিয়া আবারও দাঁড়াতে চেষ্টা করছে।
ফুটবল দলের এই সাফল্য—
- তরুণদের মধ্যে নতুন প্রেরণা তৈরি করেছে
- আন্তর্জাতিক মঞ্চে দেশের ভাবমূর্তি উন্নত করেছে
- নতুন সরকার ফুটবলসহ ক্রীড়াক্ষেত্রে বড় বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে
- বিশ্ববাসীকে দেখিয়েছে—সিরিয়ার ফুটবল আবারও জাগছে
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সাফল্য আগামী ৫ বছর সিরিয়ার ফুটবলে বড় পরিবর্তন আনবে।
ফিলিস্তিন: সীমাহীন সংকটের মধ্যেও অসীম সাহস
ফিলিস্তিন ফুটবল দল দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক ও মানবিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।
তাদের অনেক খেলোয়াড়কে বিদেশে অনুশীলন করতে হয়। দেশে নিয়মিত লিগ ম্যাচও সম্ভব হয় না।
এরপরও—
- যুব দলের উন্নতি
- আন্তর্জাতিক লিগে খেলোয়াড়দের অংশগ্রহণ
- কাতার, জর্দান, মিশর—এই তিন দেশে বন্ধুসুলভ ট্রেনিং ক্যাম্প
- ফিফার সহায়তায় প্রশিক্ষণ অবকাঠামো নির্মাণ
এসব মিলেই ফিলিস্তিন ফুটবল ইতিহাসে সোনালি সময় তৈরি করছে।
কোয়ার্টার ফাইনালে প্রতিপক্ষ কারা?
সিরিয়া ও ফিলিস্তিন এখন মুখোমুখি হবে শক্তিশালী দুই দলের—
গ্রুপ বি ও গ্রুপ সি–এর শীর্ষ দু’দলের সঙ্গে।
সম্ভাব্য প্রতিপক্ষ—
- সৌদি আরব
- আলজেরিয়া
- মরক্কো
- ইরাক
যে প্রতিপক্ষই হোক, আরব ফুটবল বিশ্ব জানে—এই দুই দল এখন অপ্রত্যাশিত চমক দিতে সক্ষম।
সমর্থকরা বলছেন—‘এটা শুধু ফুটবল নয়, আবেগের জয়’
সিরিয়া ও ফিলিস্তিনের এই অর্জন রাজনৈতিক ও সামাজিক সীমাবদ্ধতাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে।
সমর্থকদের চোখেমুখে দেখা যাচ্ছে—
- আবেগ
- ঐক্য
- গর্ব
- এবং ভবিষ্যতের স্বপ্ন
কেউ বলছেন—
‘আজ পুরো আরব বিশ্ব এক পতাকার নিচে।’
আবার কেউ বলছেন—
‘এই জয় আমাদের প্রজন্মকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে।’
এমন আনন্দ অনেক দিন পর আরব ফুটবলে দেখা গেল।
ফাইনাল নিশ্চিত নয়, কিন্তু আত্মবিশ্বাস আকাশচুম্বী
বিশেষজ্ঞদের মতে—
সিরিয়ার শক্তি: আক্রমণাত্মক ফুটবল + মানসম্মত প্লেমেকার
ফিলিস্তিনের শক্তি: সংগঠিত ডিফেন্স + পাল্টা আক্রমণের দক্ষতা
দুই দলই যদি নিজেদের খেলা ধরে রাখতে পারে তবে সেমিফাইনালেও যেতে পারে।
ফুটবল শুধু খেলা নয়—আরব বিশ্বের আশার প্রতীক
যুদ্ধ, সংঘাত, দারিদ্র্য এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝেও ফুটবল একটি জাতিকে নতুন করে বাঁচার কারণ দেয়—
সিরিয়া ও ফিলিস্তিন আজ সেই সত্যের সবচেয়ে শক্ত উদাহরণ।
এই দুই দলের সাফল্য শুধু খেলাধুলার ইতিহাস নয়, এটি মানবিক ইতিহাসও।
এটি প্রজন্মকে মনে করিয়ে দিচ্ছে—
“যে জাতি স্বপ্ন দেখতে জানে, তাকে দমিয়ে রাখা যায় না।”
MAH – 14187 I Signalbd.com



