বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সার, স্টার্টআপ উদ্যোক্তা এবং ডিজিটাল খাতের সবাই দীর্ঘদিন ধরে আন্তর্জাতিক পেমেন্ট গেটওয়ে পেপ্যাল চালুর জন্য অপেক্ষা করে আসছে। দেশের ক্রমবর্ধমান ফ্রিল্যান্স বাজার এবং ডিজিটাল অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে এই সেবা চালু হওয়ায় নতুনভাবে আশা জাগছে।
গত সোমবার আইসিটি বিভাগ, দেশের ফ্রিল্যান্স কমিউনিটি, বাক্কো এবং পেপ্যালের দক্ষিণ এশিয়া ও সিঙ্গাপুর অঞ্চলের প্রতিনিধিদের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রধান উপদেষ্টা সহকারী ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব, এবং পেপ্যালের চারজন কর্মকর্তা সিঙ্গাপুর থেকে।
ফ্রিল্যান্সারদের সরাসরি অংশগ্রহণ
বৈঠকে দেশের ১১ সদস্যের ফ্রিল্যান্সার প্রতিনিধিদল সরাসরি মতামত প্রকাশের সুযোগ পায়। তারা তুলে ধরেন বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান ফ্রিল্যান্স শিল্পের চাহিদা, পেপ্যালের সম্ভাব্য ব্যবসায়িক সুযোগ এবং ডিজিটাল অর্থনীতির বিভিন্ন আয়ের উৎস।
প্রতিনিধিরা আন্তর্জাতিক লেনদেনের বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলোও আলোচনায় উপস্থাপন করেন। যেমন:
- পেওনিয়া, স্ট্রাইপ বা ওয়াইজের ব্যবহার সীমাবদ্ধতা
- উচ্চ লেনদেন চার্জ
- অতিরিক্ত সময়ক্ষেপণ
- বিনিময় হার-সংক্রান্ত সমস্যা
ফ্রিল্যান্সাররা ব্যাখ্যা করেন যে, বাংলাদেশের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য এবং স্থায়ী আন্তর্জাতিক পেমেন্ট গেটওয়ে এখন অপরিহার্য।
অতীতের হতাশা ও বর্তমান আশার আলো
পেপ্যালকে ঘিরে আগেও অনেকবার আশাব্যঞ্জক ঘোষণা এসেছে। তবে বিভিন্ন নীতিগত জটিলতা ও ব্যাংকিং কাঠামোর সীমাবদ্ধতার কারণে তা বাস্তবে রূপ নেয়নি। এতে ফ্রিল্যান্সারদের মধ্যে প্রত্যাশা থাকলেও হতাশা তৈরি হয়েছিল।
তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। পেপ্যালের আঞ্চলিক প্রতিনিধি প্রথমবার সরাসরি বাংলাদেশে এসে নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে বৈঠক করছেন, এবং আইসিটি বিভাগ সক্রিয়ভাবে আলোচনায় নেতৃত্ব দিচ্ছে। এই নতুন উদ্যোগ বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্স এবং ডিজিটাল অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
পেপ্যালের সুবিধা ও প্রভাব
যদি পেপ্যাল চালু হয়, বাংলাদেশে ফ্রিল্যান্স কাজের ধারা পুরোপুরি বদলে যেতে পারে। প্রধান সুবিধাগুলো হলো:
- দ্রুত এবং নিরাপদ লেনদেন: আন্তর্জাতিক ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে পেমেন্ট দ্রুত গ্রহণযোগ্য হবে।
- কম খরচে লেনদেন: অতিরিক্ত চার্জ কমে আসবে।
- সময়সাশ্রয়: লেনদেনের প্রক্রিয়া সরল ও দ্রুত হবে।
- রেমিট্যান্স বৃদ্ধি: দেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রা প্রবাহ বাড়বে।
- ডিজিটাল অর্থনীতির প্রসার: স্টার্টআপ, SaaS, ই-কমার্স, প্লাগ-ইন বিক্রেতা ও অনলাইন উদ্যোক্তাদের জন্য গ্লোবাল পেমেন্ট গ্রহণ সহজ হবে।
ফ্রিল্যান্সার কাজী মামুন বলেন, “চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সময়ের ব্যাপার, তবে আলোচনার আন্তরিকতা ও সরকারি সহায়তা আমাদের আশাবাদী করেছে। যদি নীতিগত বিষয়গুলোর সমাধান হয়, পেপ্যাল চালু হওয়া বাংলাদেশের ডিজিটাল অর্থনীতির জন্য একটি বড় মাইলফলক হবে।”
বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সিং শিল্পের বর্তমান চিত্র
বাংলাদেশে ফ্রিল্যান্সিং শিল্প দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আন্তর্জাতিক পোর্টাল যেমন আপওয়ার্ক, ফ্রিল্যান্সার.কম, ফাইভার ইত্যাদিতে বাংলাদেশি ফ্রিল্যান্সারদের সংখ্যা শত শত হাজারে পৌঁছেছে। দেশজুড়ে অনলাইন কাজের মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষ স্বনির্ভরতা অর্জন করছে।
- ২০২৫ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশ প্রতি বছরে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক আয় করছে ফ্রিল্যান্সিং থেকে।
- দেশের যুব সমাজের প্রায় ২০% অনলাইন কাজের সঙ্গে যুক্ত।
- স্টার্টআপ, ই-কমার্স এবং ডিজিটাল পরিষেবার ক্রমবর্ধমান চাহিদা নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি করছে।
তবে, বর্তমানে পেমেন্ট নেওয়ার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা এবং উচ্চ চার্জ ফ্রিল্যান্সারদের বড় সমস্যা। অনেক সময় আন্তর্জাতিক ক্লায়েন্টদের সঙ্গে লেনদেন ধীর হয়ে যায়। পেপ্যাল চালু হলে এই সমস্যা দূর হবে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার সুযোগ বাড়বে।
অন্যান্য আন্তর্জাতিক পেমেন্ট গেটওয়ের প্রভাব
পেপ্যালের উপস্থিতি শুধু ফ্রিল্যান্সারদের সুবিধা দেবে না, বরং স্ট্রাইপ, স্কয়ার, ওয়ার্ল্ডপে এর মতো অন্যান্য গেটওয়ের পথও সুগম করবে। এটি বাংলাদেশের পেমেন্ট ইকোসিস্টেমকে আধুনিক করবে, লেনদেনকে স্বচ্ছ ও সহজ করবে।
ফ্রিল্যান্সার ও ডিজিটাল উদ্যোক্তারা আশা করছেন, পেপ্যালের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের পণ্য ও সেবা সহজে বিক্রি সম্ভব হবে। বিশেষ করে:
- ই-কমার্স বিক্রেতা
- SaaS (সফটওয়্যার অ্যাজ আ সার্ভিস) প্রতিষ্ঠান
- ডিজিটাল কনটেন্ট ক্রিয়েটর
- অনলাইন কোর্স প্রদানকারী
এগুলোতে আন্তর্জাতিক লেনদেনের সহজতা এবং দ্রুততা ব্যবসায়িক সম্প্রসারণে সহায়তা করবে।
সরকারের ভূমিকা
আইসিটি বিভাগ, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়, এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট দপ্তর সক্রিয়ভাবে পেপ্যাল চালুর জন্য কাজ করছে। সরকারি সহায়তা, নীতিগত সমর্থন এবং ফ্রিল্যান্সারদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করছে।
প্রতিনিধিদল আশা প্রকাশ করেছেন, বাংলাদেশে পেপ্যাল চালু হলে:
- ডিজিটাল অর্থনীতি শক্তিশালী হবে
- বিদেশি বিনিয়োগ ও বাণিজ্য বাড়বে
- নতুন প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করা সম্ভব হবে
ভবিষ্যতের প্রভাব
পেপ্যাল চালু হলে শুধু ফ্রিল্যান্সারদের নয়, দেশের সকল ডিজিটাল উদ্যোক্তা ও স্টার্টআপদের উপকার হবে। এটি আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, “পেপ্যালের আসা মানে বাংলাদেশের ডিজিটাল অর্থনীতিতে নতুন অধ্যায়ের সূচনা। এটি শুধু আর্থিক লেনদেনের সরলতা নয়, বরং দেশের গ্লোবাল প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়াবে।
MAH – 14184 I Signalbd.com



