শিক্ষা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক বরখাস্ত: যৌন হয়রানির নতুন ঘটনা

Advertisement

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) আবারও এক শোকের ঘটনায় উত্তাল। রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক মো. এরশাদ হালিমের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানির অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এই অভিযোগের তদন্তের জন্য কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে এবং অধ্যাপককে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে।

ঢাবির উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেট সভায় এ সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেছেন। সিন্ডিকেট সভার সূত্রে জানা যায়, অভিযোগের প্রাথমিক প্রমাণের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করার জন্য একটি পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন।

তদন্ত কমিটি ও তার কার্যক্রম

তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. মাজহারুল ইসলাম শাহীন। এছাড়া কমিটিতে অন্যান্য সদস্য হিসেবে রয়েছেন:

  • ব্যারিস্টার মনিরুজ্জামান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী
  • সহকারী প্রক্টর এনামুল হক সজীব
  • অভিযুক্ত অধ্যাপক কর্তৃক মনোনীত একজন প্রতিনিধি
  • বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার (তদন্ত), যিনি কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন

কমিটিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে আগামী তিন মাসের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আশা করছে, এ ধরনের ঘটনা পুনরায় ঘটতে না দেওয়ার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মামলার বিস্তারিত ও আদালতের সিদ্ধান্ত

এর আগে, শিক্ষার্থীদের যৌন হয়রানির অভিযোগে করা মামলায় অধ্যাপক এরশাদ হালিমের জামিন নামঞ্জুর করে আদালত তাকে কারাগারে প্রেরণ করেছেন। ১৪ নভেম্বর বিকেলে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মাহবুব আলমের আদালতে তদন্ত কর্মকর্তার আবেদনের শুনানির পর এ আদেশ প্রদান করা হয়।

মামলার তদন্ত সূত্রে জানা যায়, ১৩ নভেম্বর রাতে অধ্যাপককে শেওড়াপাড়া থেকে হেফাজতে নেয়া হয় এবং পরবর্তীতে মিরপুর থানার মাধ্যমে আদালতে হাজির করা হলে জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। মামলাটি ঢাবি রসায়ন বিভাগের ৮ জন শিক্ষার্থী করেছেন।

অভিযোগের মূল বিবরণ

মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, ভুক্তভোগী একজন স্নাতক ছাত্র। ২৬ সেপ্টেম্বর, বিভাগের পদার্থবিজ্ঞান মাইনর ল্যাব পরীক্ষার একটি সমস্যার সমাধানের কথা বলে অধ্যাপক তাকে মিরপুরের বাসায় ডাকেন। সেখানে শিক্ষার্থীকে যৌন নির্যাতনের শিকার করা হয়।

এজাহারে আরও বলা হয়েছে, অধ্যাপক ভুক্তভোগীকে ভয়ভীতি দেখানো, পুনরায় বাসায় যেতে বাধ্য করা এবং পরবর্তী সময়ে আবারও নির্যাতন করার চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে নির্যাতনের ফলে ভুক্তভোগী জ্ঞান হারান এবং পরদিন সকাল সাড়ে ৭টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নামিয়ে দেওয়া হয়।

এ ঘটনায় ১৪ অক্টোবর মিরপুর মডেল থানায় মামলা দায়ের করা হয়। তদন্ত কর্মকর্তা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।

অভিযুক্তের আইনজীবীর যুক্তি

অভিযোগ আনা সময় পর্যন্ত প্রায় এক মাস পরে মামলা করা হলেও, অভিযুক্তের আইনজীবী যুক্তি দেন, এটি অভ্যন্তরীণ বিভাগীয় রাজনীতির শিকার হওয়া। তিনি বলেন, অধ্যাপক গবেষণা ও প্রকাশনায় সক্রিয় থাকার কারণে এই অভিযোগ আনা হয়েছে।

তবে আদালত এই যুক্তি গ্রহণ না করে, মামলার প্রাথমিক প্রমাণের ভিত্তিতে অধ্যাপককে কারাগারে প্রেরণের নির্দেশ দেন।

শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পদক্ষেপ

ঢাবি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেবে। শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষকের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা এবং যৌন হয়রানি প্রতিরোধে বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিশ্চিত করেছে, তদন্ত চলাকালীন অধ্যাপককে কোনো শিক্ষার্থী বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমে যুক্ত করা হবে না।

সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপট

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন অভিযোগ নতুন নয়। পূর্বেও শিক্ষকদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রতিটি ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিত করার চেষ্টা করছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট, প্রশাসন এবং তদন্ত কমিটি আশা করছে, এই ঘটনা শিক্ষার্থীদের মানসিক ও শারীরিক নিরাপত্তা সুরক্ষিত রাখার ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।

শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ও মানসিক সহায়তা

বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যে একটি মানসিক স্বাস্থ্য ও কাউন্সেলিং সেল চালু করেছে, যেখানে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ পরিবেশে তাদের সমস্যা ব্যক্ত করতে পারেন। শিক্ষার্থীদের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার (তদন্ত) জানিয়েছেন, তদন্তের সময় শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া হবে।

আন্তর্জাতিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া

এই ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শিক্ষার্থীদের প্রতি সমর্থন জানানো হয়েছে। শিক্ষার্থীরা নিরাপদ শিক্ষা পরিবেশের জন্য চাপ সৃষ্টি করছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও দায়িত্বশীলতা বজায় রাখা অতীব গুরুত্বপূর্ণ।

আগামী পদক্ষেপ

তদন্ত কমিটি আগামী তিন মাসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগত ও মানসিক স্বার্থে এই পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমদ খান বলেছেন, “আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যে, কোনো শিক্ষার্থীকে নির্যাতনের শিকার হতে দেওয়া হবে না। যে কোনো অভিযোগ স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করা হবে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ঘটনা প্রমাণ করছে, শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিয়ে প্রশাসনের দায়িত্ব কতটা গুরুত্বপূর্ণ। যৌন হয়রানি, ভয়ভীতি ও শিক্ষার্থী শোষণ প্রতিরোধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।

শিক্ষার্থীরা আশা করছেন, এ ধরনের ঘটনা পুনরায় ঘটবে না এবং বিশ্ববিদ্যালয় তাদের শিক্ষাগত ও মানসিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।

শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং শিক্ষকদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা আজকের শিক্ষাঙ্গনের এক অপরিহার্য দায়িত্ব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই পদক্ষেপ এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে, যেখানে শিক্ষার্থীরা নিরাপদ ও সুরক্ষিত পরিবেশে শিক্ষা লাভ করতে পারবেন।

MAH – 14183 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button