বানিজ্য

৬ দফা দাবিতে উত্তাল টেক-বাজার, মোবাইল দোকান বন্ধ

Advertisement

বাংলাদেশের মোবাইল বাজারে নজিরবিহীন অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। আমদানী শুল্ক, এনইআইআর (NEIR) বাস্তবায়ন এবং আমদানী নিয়মের পরিবর্তনসহ বেশ কিছু সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সারাদেশের মোবাইল দোকান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছেন দেশের লাখো ক্ষুদ্র–মাঝারি মোবাইল ব্যবসায়ী। একই সঙ্গে রোববার (৭ ডিসেম্বর) সকাল থেকেই রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন—বিটিআরসি ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন তাদের বিভিন্ন সংগঠনের সদস্য ও কর্মচারীরা।

সকাল থেকেই বিটিআরসি ভবনের চারপাশে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে পুরো এলাকায়। ব্যবসায়ীরা শান্তিপূর্ণ অবস্থানে থাকলেও পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সতর্ক অবস্থায় রয়েছে।

এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে ‘মোবাইল বিজনেস কমিউনিটি বাংলাদেশ’। সংগঠনটি শনিবার সন্ধ্যায় জরুরি বৈঠকের পর ঘোষণা দেয়—সরকার তাদের দাবিগুলো না মানা পর্যন্ত দেশের সব মোবাইল দোকান বন্ধ থাকবে।

কেন এই আন্দোলন? পেছনের বড় কারণ: এনইআইআর বাস্তবায়ন

ব্যবসায়ীদের দাবি, বিটিআরসি এনইআইআর (National Equipment Identity Register) বাস্তবায়নের মাধ্যমে মোবাইল বাজারে অন্যায় নিয়ন্ত্রণ, মনোপলি সৃষ্টি এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ধ্বংস করছে।

এনইআইআর হলো একটি সিস্টেম, যেখানে দেশের প্রতিটি মোবাইল ফোনের আইএমইআই (IMEI) নিবন্ধন বাধ্যতামূলক। বিটিআরসির যুক্তি—চুরি-ডাকাতি কমানো, অবৈধ মোবাইল আমদানী ঠেকানো এবং গ্রাহক সুরক্ষা নিশ্চিত করা। কিন্তু ব্যবসায়ীদের অভিযোগ—

১) এনইআইআর বাস্তবায়নের পদ্ধতি জটিল

ফলে লাখ লাখ ব্যবসায়ী বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অনেকের কাছে থাকা মোবাইল ফোন স্টক এনইআইআরে নিবন্ধনের ঝুলে থাকতে পারে। এতে তারা মোবাইল বিক্রি করতে পারছেন না।

২) গ্রাহক পর্যায়ে মোবাইলের দাম বাড়বে

কর বাড়ানো, নিবন্ধন ফি যোগ হওয়া, আমদানী জটিলতা—সব মিলিয়ে মোবাইল ফোনের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে।

৩) স্থানীয় প্রস্তুতকারক ও কিছু বড় আমদানিকারকের হাতে বাজার আটকে যাবে

ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন—নতুন নিয়মে বাজারে প্রতিযোগিতা কমে যাবে। বড় কোম্পানিগুলো লাভবান হবে, আর ছোট ব্যবসায়ীরা ধুঁকবে।

৪) লক্ষাধিক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও কর্মচারী বেকার হওয়ার আশঙ্কা

বাংলাদেশে মোবাইল ব্যবসা সংশ্লিষ্ট মানুষ সংখ্যা প্রায় ২০ থেকে ২৫ লাখ। তাদের বড় একটি অংশ এই নিয়মের কারণে ব্যবসা বন্ধের মুখে পড়বে বলে দাবি করা হচ্ছে।

ব্যবসায়ীদের মূল ৬ দফা দাবি

ব্যবসায়ীরা যেসব দাবি উপস্থাপন করেছেন, সেগুলো হলো—

১) স্মার্টফোন আমদানিতে বাধ্যতামূলক চুক্তি বাতিল

বর্তমান নিয়মে মোবাইল আমদানীকারকদের স্থানীয় স্মার্টফোন প্রস্তুতকারকদের সঙ্গে বাধ্যতামূলক চুক্তি করতে হয়। ব্যবসায়ীরা বলছেন—এটি মুক্ত বাণিজ্যের পরিপন্থী।

২) আমদানী শুল্ক ১৫ শতাংশে নির্ধারণ

বর্তমানে মোবাইল আমদানীতে ৬৮–৭০% পর্যন্ত কর প্রযোজ্য হয়। এতে ব্যবসা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তারা দাবি করছেন—সব ব্যবসায়ীর জন্য সমানভাবে ১৫% শুল্ক ধার্য করতে হবে।

৩) এনইআইআর সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে সিস্টেম চালানো হলে তারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে—এমন আশঙ্কা রয়েছে। তাই সরকারকে সরাসরি তদারকির দাবি।

৪) দেশে থাকা অবিক্রীত মোবাইল বিক্রির সুযোগ দিতে হবে

ব্যবসায়ীদের দোকানে থাকা স্টক যেগুলো এনইআইআরে নিবন্ধিত নয়—এগুলোর বিক্রিতে কোনো বাধা না দেয়ার দাবি। অন্যথায় কোটি কোটি টাকার পণ্য আটকে যাবে।

৫) এনইআইআর চালুর আগে ছয় মাস পরীক্ষামূলক কার্যক্রম

ব্যবসায়ীরা বলছেন—সিস্টেমটি সঠিকভাবে বুঝতে এবং মানিয়ে নিতে সময় প্রয়োজন।

৬) বিটিআরসির ভেন্ডর এনলিস্টমেন্ট প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে

বর্তমান প্রক্রিয়া ধীর, জটিল এবং ব্যয়বহুল—যার ফলে ছোট ব্যবসায়ীরা পিছিয়ে পড়ছেন।

ঢাকার বাইরে আন্দোলনের ঢেউ

রাজধানীতে চলছে অবস্থান কর্মসূচি, তবে চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, রংপুর, বরিশালসহ সব বিভাগীয় শহরে মোবাইল দোকান বন্ধ রয়েছে।
অনেক জেলা–উপজেলাতেও ব্যবসায়ীরা মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন।

ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর বক্তব্য—

“আমরা কোনোভাবেই সহিংসতা চাই না। আমরা শুধু বাঁচার অধিকার চাই। এনইআইআর বাস্তবায়নে যদি ছোট ব্যবসায়ীরা ধ্বংস হয়, তাহলে দেশের টেক–বাজার ধসে পড়বে।”

গ্রাহকদের দুর্ভোগ: মোবাইল কিনতে গিয়ে ফিরে আসছেন ক্রেতারা

দোকান বন্ধ থাকায় গ্রাহকরা নতুন মোবাইল বা রিপেয়ারিং সেবা পাচ্ছেন না।
অপরদিকে, অধিকাংশ মোবাইল সার্ভিস সেন্টারও বন্ধ রয়েছে।

অনেকে অভিযোগ করছেন—

  • পরীক্ষার আগে সন্তানকে নতুন ফোন কিনে দিতে পারছেন না
  • অনলাইন ব্যবসায়ীরা স্টক দিতে পারছেন না
  • রিপেয়ারিং সার্ভিস বন্ধ থাকায় জরুরি কাজ আটকে আছে

সরকার কী বলছে?

বিটিআরসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন—

  • এনইআইআর গ্রাহক স্বার্থরক্ষার জন্য করা হচ্ছে
  • অবৈধ মোবাইলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি
  • কোনো ব্যবসায়ী যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে ব্যাপারে তারা আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন

তারা ব্যবসায়ী নেতাদের আলোচনায় বসার অনুরোধ জানিয়েছেন।
তবে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন—
“দাবি পূরণের স্পষ্ট ঘোষণা ছাড়া দোকান খুলবে না।”

বাংলাদেশে মোবাইল বাজারের বাস্তব চিত্র

বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৩ কোটি স্মার্টফোন বিক্রি হয়।
এর মধ্যে—

  • প্রায় ৮০% আমদানী
  • ২০% স্থানীয় কারখানায় উৎপাদন

দেশে মোবাইল বাজারের পরিমাণ প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা
এই বিশাল বাজারে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাই সবচেয়ে বড় অংশীদার।

যদি এনইআইআর বাস্তবায়ন কঠোর হয় এবং আমদানিশুল্ক বাড়তে থাকে, তাহলে—

  • বাজারে ফোনের দাম বাড়বে
  • স্মার্টফোন বিক্রি কমবে
  • ই–কমার্স ও ডিজিটাল সেবার ব্যবহার কমে যেতে পারে
  • সরকারি ভ্যাট ও ট্যাক্স আয়েও প্রভাব পড়বে

ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা—”মোবাইল হবে বিলাস পণ্য”

বাংলাদেশে বেশিরভাগ মানুষ ১৫–২৫ হাজার টাকার মাঝারি দামের ফোন ব্যবহার করে।
নতুন কর ব্যবস্থায় সেই ফোনও ২৫–৩৫ হাজার টাকায় পৌঁছাতে পারে।

এক ব্যবসায়ী বললেন—

“এভাবে চললে সাধারণ মানুষ নতুন ফোন কিনতেই পারবে না। স্মার্টফোন আবার বিলাস পণ্য হয়ে যাবে।”

এনায়ার (NEIR) আসলে কী, কেন বিতর্ক? – সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ

এনইআইআর মূলত তিনটি লক্ষ্য নিয়ে করা হয়—

  1. অবৈধ ফোন শনাক্ত
  2. চুরি-ডাকাতি কমানো
  3. আমদানী নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী করা

কিন্তু সমস্যাগুলো হলো—

  • সিস্টেমটি দেশে পুরোপুরি প্রস্তুত নয়
  • সার্ভার ফেইল হলে গ্রাহক বিপদে পড়তে পারে
  • অনেক ফোন ভুলভাবে ‘অবৈধ’ দেখাতে পারে
  • নিবন্ধন ফি ও ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়া ব্যবসায়ীদের জন্য ব্যয়বহুল

ভারত, পাকিস্তান, নেপালেও একই ধরনের সিস্টেম চালু আছে—
কিন্তু সেখানেও ব্যবসায়ীরা প্রথম দিকে আন্দোলন করেছিলেন।

এই আন্দোলনের সম্ভাব্য প্রভাব

১) মোবাইল দামের দ্রুত বৃদ্ধি

আমদানী বন্ধ থাকলে বাজারে ঘাটতি তৈরি হবে।

২) ডিজিটাল বাংলাদেশের অগ্রগতিতে বাধা

সরকার বিভিন্ন খাতে স্মার্টফোন ব্যবহারে উৎসাহী—কিন্তু বাজার অস্থিতিশীল হলে তার প্রভাব সবখানে পড়বে।

৩) কর্মসংস্থান সংকট

লাখো কর্মচারী বেকার হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

৪) ই–কমার্স ধস

বাংলাদেশের ই–কমার্সে প্রায় ৭০% বেচাকেনাই মোবাইল ও ইলেকট্রনিকস পণ্যের মাধ্যমে।

বিটিআরসি সামনে আজকের অবস্থান কর্মসূচি কেমন ছিল?

সকালে থেকেই আগারগাঁওয়ে ভিড় বাড়তে থাকে। ব্যবসায়ীরা শান্তিপূর্ণভাবে ব্যানার, প্ল্যাকার্ড নিয়ে অবস্থান করেন। তাদের বক্তব্য—

“আমরা নিপীড়নের শিকার। আমরা কর দিই, ব্যবসা করি—অবৈধ কোনো কাজ করি না।
আমাদের বাঁচার সুযোগ দিতে হবে।”

অনেক দোকান কর্মীও উপস্থিত ছিলেন।
তারা বলছেন—ব্যবসা বন্ধ থাকলে দোকান মালিকরা বেতন দিতে পারবেন না।

আন্দোলন কবে শেষ হবে?

ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন—

  • আনুষ্ঠানিকভাবে ৬ দফা দাবি মেনে না নেওয়া পর্যন্ত তারা পিছু হটবেন না
  • আলোচনার আহ্বান এলে তারা বসবেন, কিন্তু দোকান খোলা হবে না

সরকার–বিটিআরসি–ব্যবসায়ী—
এই তিন পক্ষের আলোচনাই এখন সবকিছু নির্ধারণ করবে।

বাংলাদেশের মোবাইল শিল্প শুধু একটি বাণিজ্য খাত নয়—
ডিজিটাল অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি।

ব্যবসা–নিয়ন্ত্রণ–কর—এই তিন ক্ষেত্র সঠিকভাবে সমন্বিত না হলে
এর বিপর্যয় পুরো দেশের প্রযুক্তি অগ্রগতিতে আঘাত হানতে পারে।

দুই পক্ষের উচিত দ্রুত আলোচনায় বসা,
এবং সাধারণ মানুষের ভোগান্তি কমানো।

MAH – 14157 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button