লিওনেল মেসির পায়ের জাদু ফুটবলকে কতবার যে বিস্মিত করেছে, তার কোনো হিসাব নেই। বার্সেলোনা থেকে আর্জেন্টিনা—যেখানেই খেলেছেন, শিরোপা যেন তাঁর ছায়াসঙ্গী। এবার সেই জাদুকরী আলো ছড়িয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মেজর লিগ সকারে (এমএলএস) আলোড়ন তুললেন। ভ্যাঙ্কুভার হোয়াইটক্যাপসকে ৩–১ গোলে হারিয়ে ইন্টার মায়ামিকে এনে দিলেন তাদের ইতিহাসের প্রথম এমএলএস কাপ শিরোপা।
এই জয়ের মধ্য দিয়ে ইন্টার মায়ামি শুধু একটি ট্রফি জেতেনি—তারা নতুনভাবে লিখে ফেলেছে ক্লাব ইতিহাস, এমএলএস-এর নতুন বাণিজ্যিক শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে, আর সবচেয়ে বড় কথা—মেসির আগমনে আমেরিকার ফুটবল যে নতুন মাত্রায় উন্নীত হয়েছে, তার প্রমাণ আবারও মিলল।
ম্যাচের শুরু থেকেই মেসির প্রভাব
ম্যাচের প্রথম বাঁশি বাজার পর থেকেই ইন্টার মায়ামির খেলোয়াড়েরা বোঝাতে শুরু করেন যে তারা আজই ইতিহাস গড়তে চায়। বল দখল, আক্রমণের পর আক্রমণ এবং পাসিং ফুটবলে মায়ামি শুরু থেকেই ভ্যাঙ্কুভারকে চাপে রাখতে থাকে।
ওকাম্পোর আত্মঘাতী গোল—মায়ামির লিড
প্রথমার্ধে খেলায় অস্বস্তিতে থাকা ভ্যাঙ্কুভারের ডিফেন্সের ভুলেই আসে ম্যাচের প্রথম গোল। এদিয়ের ওকাম্পোর আত্মঘাতী গোলে প্রথম লিড নেয় ইন্টার মায়ামি।
এই গোলের পর মায়ামির খেলোয়াড়দের মধ্যে আরও আত্মবিশ্বাস দেখা যায়। মেসি মাঝমাঠ থেকে খেলা নিয়ন্ত্রণ করছিলেন, ডান-পাশে লোকের, বাম-পাশে ক্যাম্পানায়া—সবার সমন্বয়ে তৈরি হচ্ছিল একের পর এক আক্রমণ।
তবে প্রথমার্ধে আর গোল হয়নি। ১–০ গোলে এগিয়ে থেকেই বিরতিতে যায় ইন্টার মায়ামি।
ভ্যাঙ্কুভারের ফিরে আসার চেষ্টা এবং সমতার গোল
বিরতির পর আক্রমণধর্মী খেলায় ফেরার চেষ্টা করে ভ্যাঙ্কুভার। অবশেষে ৬০ মিনিটে আলী আহমেদের শটে সমতা ফেরে ম্যাচে।
এই গোলের পর পরিস্থিতি বদলে যায়। ভ্যাঙ্কুভারের আত্মবিশ্বাস ফিরে আসে। খেলার ৬৪তম মিনিটে এমানুয়েল সাব্বির একটি দুর্দান্ত শট পোস্টে লেগে ফিরে আসে—নাহলে মায়ামি তখনই পিছিয়ে যেত।
ম্যাচ তখন উত্তেজনার চূড়ায়। স্কোর ১–১, কিন্তু খেলার নিয়ন্ত্রণের লাগাম তখনও মেসির হাতে।
৭২ মিনিটে মেসির জাদুকরী পাস—ডি পলের গোল, মায়ামির আবার লিড
৭২ মিনিটে ম্যাচে আসে বাঁকবদল।
মাঝমাঠে বল পেয়ে মেসি যেন পুরো মাঠ নয়, প্রতিটি খেলোয়াড়ের চলাচল—সবকিছু দেখছিলেন একসঙ্গে। হঠাৎই চোখের পলকে ডি পলকে দেখা যায় ফাঁকা জায়গায় দৌড়াতে।
মেসি সেই নিখুঁত থ্রু পাস দিলেন—যেমনটি তিনি ক্যারিয়ারে হাজারবার দিয়েছেন।
বল পেয়ে দারুণ দক্ষতায় গোল করে ডি পল দলকে আবার এগিয়ে নেন।
স্কোরলাইন তখন ২–১—ইন্টার মায়ামির শিরোপা স্বপ্ন আবার জেগে ওঠে আলো হয়ে।
৯৬ মিনিটে আলেন্দের গোল—মায়ামির স্বপ্ন সত্যি হয়ে ওঠার মুহূর্ত
ম্যাচের শেষ মিনিটগুলো ছিল উত্তেজনায় ভরা। ভ্যাঙ্কুভার সমতায় ফেরার জন্য মরিয়া হয়ে আক্রমণে উঠে আসছিল।
কিন্তু অতিরিক্ত সময়ের ৯৬ মিনিটে আবারও আবির্ভাব মেসির। মাঝমাঠ থেকে বল পেয়ে তিনি পাশে থাকা আলেন্দেকে নিখুঁত একটি পাস দেন।
আলেন্দে দৌড়ে ঢুকে জোরালো শটে গোল করে নিশ্চিত করেন ইন্টার মায়ামির ইতিহাস গড়া জয়।
স্টেডিয়ামে তখন শুধুই আনন্দ, উচ্ছ্বাস, উল্লাস—মেসি-ম্যাজিকে মায়ামির জয়গান।
কেন এই শিরোপা ইন্টার মায়ামির জন্য এত বড় অর্জন?
১. ক্লাব ইতিহাসের প্রথম এমএলএস কাপ
২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে মায়ামির যাত্রা ছিল দোলাচলে ভরা।
ডেভিড বেকহ্যামের স্বপ্নের এই ক্লাব শুরুতে কাঠামোগত সমস্যা, অর্থনৈতিক সংকট এবং কোচিং বদলের মধ্য দিয়ে গেছে।
কিন্তু মেসির আগমনের পর বদলে যায় সবকিছু।
আজকের শিরোপা সেই পরিবর্তনের পরিপূর্ণ সফলতা।
২. আমেরিকান ফুটবলের বাণিজ্যিক বিপ্লব
মেসি যখন এমএলএস-এ যোগ দিলেন, শুধু ফুটবল নয়—পুরো মার্কিন ক্রীড়া ব্যবসায় এক তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
টিকিট বিক্রি, জার্সি বিক্রি, স্টেডিয়ামের দর্শকসংখ্যা, টেলিভিশন রেটিং সবই বৃদ্ধি পায়।
এই শিরোপা এমএলএস-এর জনপ্রিয়তাকে আরও কয়েক ধাপ উপরে নিয়ে যাবে।
৩. মেসির ক্যারিয়ারের ‘নতুন অধ্যায়’
বার্সেলোনা—পিএসজি—আর্জেন্টিনা—তারপর ইন্টার মায়ামি।
যেখানে গেছেন, সেখানেই শিরোপা জিতেছেন।
এমএলএস কাপ জয় তাঁর ক্যারিয়ারের একটি মূল্যবান পালক।
৪. বুস্কেটেসের বিদায়—মেসির উপহার
মেসির ঘনিষ্ঠ বন্ধু সার্জিও বুস্কেটেসের ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ ছিল এটি।
বুস্কেটেসকে বিদায়ী উপহার হিসেবে মেসি সবচেয়ে মূল্যবান কিছুই দিতে পারতেন—একটি লিগ শিরোপা।
আর ঠিক তাইই তিনি করলেন।
মায়ামির সাফল্যের পেছনে মেসির ভূমিকা
মাঠে নেতৃত্ব
তিনি শুধু গোল করেন না—খেলা সাজান, গতি ঠিক করেন, ডিফেন্সকে সাজাতে সাহায্য করেন। পুরো দল তাঁর নেতৃত্বে যেন আরও সৃজনশীল হয়ে ওঠে।
যুব খেলোয়াড়দের অনুপ্রেরণা
মায়ামির অ্যাকাডেমির তরুণ খেলোয়াড়রা মেসিকে আদর্শ হিসেবে দেখে।
স্টেডিয়ামে তাঁকে প্রতিদিন দেখার সুযোগ তাদের মানসিক বৃদ্ধি ও আত্মবিশ্বাস বাড়ায়।
দলের সংস্কৃতিতে পরিবর্তন
মেসির পেশাদার মনোভাব ও নিষ্ঠা দলের সংস্কৃতি পুরোপুরি পরিবর্তন করেছে।
আজ মায়ামি একটি শক্তিশালী ও শৃঙ্খলাবদ্ধ দল—এর পেছনে অবদান সবচেয়ে বেশি মেসির।
এই জয়ে এমএলএসে নতুন যুগের সূচনা
মেসির আগমনে আগেই এমএলএস আলোচনায় ছিল।
কিন্তু আজকের শিরোপা শুধু একটি সংবাদ নয়—এটি আমেরিকান ফুটবলে নতুন যুগের সূচনা।
এমএলএসের আন্তর্জাতিক গুরুত্ব বাড়বে
ইউরোপ-দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবলপাড়ায় এখন এমএলএসকে আর তাচ্ছিল্যের চোখে দেখা হবে না।
মেসির মতো তারকারা প্রমাণ করেছেন—এই লিগেও উচ্চমানের ফুটবল সম্ভব।
ব্যবসায়িক বিনিয়োগ বাড়বে
বিনিয়োগকারীরা এখন দেখছে—এক ক্লাব যদি সঠিক পরিকল্পনায়, সঠিক তারকাকে এনে দল সাজাতে পারে, তাহলে এমএলএস-এ সাফল্য ও বাণিজ্যিক লাভ দুটোই সম্ভব।
ভ্যাঙ্কুভারের লড়াই—শেষ পর্যন্ত গর্বিত হার
স্কোর ৩–১ হলেও ভ্যাঙ্কুভার লড়াই করে গেছে শেষ পর্যন্ত।
তাদের পোস্টে লেগে ফিরে আসা শট ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারত।
যদি সে বল পোস্টে না লেগে জালে ঢুকত, পুরো গল্পই ভিন্ন হতে পারত।
তবে শেষ পর্যন্ত মেসির কারণে ফুটবলের সৌন্দর্যই জয় পেয়েছে।
ইন্টার মায়ামির পরবর্তী লক্ষ্য কী?
এই জয়ে ইন্টার মায়ামি এখন নতুন উচ্চতায়।
আগামী মৌসুমে তারা কনকাকাফ চ্যাম্পিয়নস লিগে ইতিহাস গড়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে।
মেসি, সুয়ারেজ, ডি পল, আলেন্দে—তারা সবাই মিলে আরও বড় কিছু করতে চাইবে।
ডেভিড বেকহ্যামও বলেছেন—
“এই শিরোপা শুধু শুরু। ইন্টার মায়ামি আগামী দশকে বিশ্বের অন্যতম বড় ক্লাব হবে।”
MAH – 14156 I Signalbd.com



