বিশ্ব

বিশ্বজুড়ে ২৫ কোটি ১০ লাখ শিশু শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত

Advertisement

বিশ্বজুড়ে শিক্ষা আজ চরম বৈষম্যের মুখে দাঁড়িয়ে। প্রযুক্তির অগ্রগতি ও উন্নত রাষ্ট্রগুলোর সমৃদ্ধির বিপরীতে নিম্ন আয়ের দেশসমূহে লাখ লাখ শিশু এখনো শিক্ষা-বঞ্চিত, অরক্ষিত এবং ভবিষ্যৎহীন। শিক্ষা একটি সর্বজনীন অধিকার হলেও—বিশ্বের কোটি কোটি শিশুর কাছে এখনো তা অধরা। ঠিক এই বাস্তবতাই আবারও সামনে তুলে ধরলেন তুরস্কের ফার্স্ট লেডি আমিনা এরদোগান।

২০২৫ সালের ৫ম ইস্তাম্বুল শিক্ষা সম্মেলনে তিনি জানান—২০২৪ গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বে মোট ২৫ কোটি ১০ লাখ শিশু ও তরুণ-তরুণী এখনো শিক্ষার বাইরে রয়ে গেছে। এই সংখ্যাটি শুধু একটি পরিসংখ্যান নয়, মানবতার বেদনাদায়ক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি।

তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন—উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে মাত্র ৩% শিশু স্কুলের বাইরে থাকলেও নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে এই হার ৩৩%। অর্থাৎ আয়, নিরাপত্তা ও সামাজিক অবস্থা শিক্ষার সবচেয়ে বড় নির্ধারক উপাদান হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ইস্তাম্বুলে বিশ্বশিক্ষা নিয়ে দুই দিনের আন্তর্জাতিক সম্মেলন

তুরস্কের রাজধানী ইস্তাম্বুলে মারিফ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আয়োজিত এই দুই দিনের সম্মেলনে অংশ নেয় এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, শিক্ষাবিদ ও নীতিনির্ধারকরা।

সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য ছিল—

“শিক্ষার মাধ্যমে বিশ্বকে সুস্থ করা”

এই প্রতিপাদ্যই ইঙ্গিত দেয় যে, শিক্ষা কেবল জ্ঞান অর্জনের মাধ্যম নয়—এটি মানবিকতা, ন্যায়বিচার, শান্তি ও উন্নয়নের শক্তি।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন—

  • তুরস্কের ফার্স্ট লেডি আমিনা এরদোগান
  • সিরিয়ার ফার্স্ট লেডি লাতিফা আল–দরুবি
  • তুরস্কের জাতীয় শিক্ষা মন্ত্রী ইউসুফ তেকিন
  • মারিফ ফাউন্ডেশনের প্রধান মাহমুদ ওজদিল

উপস্থিত অতিথিদের বক্তব্যে উঠে আসে—শিক্ষা সংকট আজ আর কোনো দেশের একক সমস্যা নয়; এটি বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা, মানব উন্নয়ন ও শান্তির জন্য বড় হুমকি।

শিক্ষা মানবতার আত্মাকে পুষ্ট করে—আমিনা এরদোগান

ফার্স্ট লেডি আমিনা এরদোগান তাঁর হৃদয়গ্রাহী বক্তৃতায় বলেন—

“শিক্ষা এমন এক শক্তি, যা মানবতার আত্মাকে পুষ্ট করে, ক্ষত সারায় এবং অন্ধকার দূর করে। ন্যায়ভিত্তিক বিশ্ব গড়তে সবার জন্য শিক্ষার সমান সুযোগ নিশ্চিত করা জরুরি।”

তিনি বিশ্বকে স্মরণ করিয়ে দেন—প্রতিটি শিশুর মেধা সমান মূল্যবান। জন্মপরিবেশ কোনো শিশুর ভবিষ্যৎ নির্ধারণের একমাত্র উপাদান হতে পারে না।

তার বক্তৃতায় বৈশ্বিক শিক্ষাবঞ্চনার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে আসে—

১. বৈশ্বিক দারিদ্র্য শিক্ষার সবচেয়ে বড় বাধা

নিম্ন আয়ের দেশের অধিকাংশ পরিবার দারিদ্র্যের কারণে সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে পারে না। অনেক ক্ষেত্রে শিশুদের কর্মজীবনে নামতে হয় পরিবারকে সহযোগিতা করার জন্য।

২. সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে স্কুল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে

মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকার কিছু অঞ্চল, ইউক্রেন এবং এশিয়ার কিছু স্থানে যুদ্ধের কারণে হাজার হাজার স্কুল ধ্বংস বা পরিত্যক্ত। ফলে লাখ লাখ শিশু বছরের পর বছর শিক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন।

৩. জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব শিক্ষাকে সরাসরি বিপর্যস্ত করছে

বন্যা, খরা, দুর্যোগ—এসব কারণে স্কুল বন্ধ থাকে, শিক্ষাকে বাধাগ্রস্ত করে। দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকার বহু দেশে এই চিত্র এখন নিয়মিত।

৪. ড্রপআউট ও বৈষম্য বাড়ছে

বিশেষত মেয়েদের বিদ্যালয়ত্যাগের হার বহু দেশে বাড়ছে। নিরাপত্তা সংকট, বাল্যবিবাহ, দারিদ্র্য—এসবই এর প্রধান কারণ।

তিনি বিশ্ববাসীকে স্মরণ করিয়ে দেন—একটি শিশুর শিক্ষা বঞ্চিত হওয়া মানে পুরো সমাজের একটি সম্ভাবনা হারিয়ে যাওয়া।

সিরিয়ার হৃদয়বিদারক বাস্তবতা: যুদ্ধ শিশুদের ভবিষ্যৎ ছিনিয়ে নিয়েছে

সিরিয়ার ফার্স্ট লেডি লাতিফা আল–দরুবি, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমদ শর’আ আল–জুলানীর স্ত্রী, তাঁর বক্তব্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার শিক্ষাব্যবস্থার ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেন।

তিনি বলেন—

“হাজার হাজার স্কুল ধ্বংস হয়েছে। এখনো প্রতি তিনজন শিশুর একজন শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে না। অনেকেই ছাদহীন ভবনে ক্লাস করে, মোমবাতির আলোয় পড়াশোনা চালিয়ে যায়।”

এই অবস্থায় লাখো শিশুর ভবিষ্যৎ অন্ধকারে নিমজ্জিত।

তবে গভীর সংকটের মধ্যেও তিনি আশাবাদী। তাঁর কথায়—

“প্রতিভাকে ধ্বংস করা যায় না। বিজ্ঞান, জ্ঞান ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে সিরিয়া আবারও উঠে দাঁড়াবে।”

তিনি বিশ্বের উন্নত দেশগুলোকে অনুরোধ করেন সিরিয়ার শিক্ষা পুনর্গঠনে সহায়তা বাড়ানোর জন্য। কারণ শিক্ষা পুনরুদ্ধার না হলে যুদ্ধোত্তর সমাজ কখনই টেকসই শান্তি ও উন্নয়নের পথে এগোতে পারবে না।

শিক্ষাবঞ্চিত ২৫ কোটি শিশুর পেছনের কারণ—ইউনিসেফ ও ইউনেস্কোর তথ্য

সম্মেলনে আলোচিত হয়েছে বিশ্বব্যাপী শিক্ষাবঞ্চনা পরিস্থিতির গভীর বিশ্লেষণ। ইউনিসেফ, ইউনেস্কো ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী—

১. সংঘাত ও যুদ্ধ

বিশ্বে যে শিশু স্কুলের বাইরে রয়েছে, তাদের প্রায় ৪০% বাস করে সংঘাতপূর্ণ এলাকায়।

২. দারিদ্র্য

দারিদ্র্যপীড়িত পরিবারে জন্ম নেওয়া শিশুরা স্কুলে যাওয়ার তুলনায় শ্রমে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

৩. লিঙ্গ-বৈষম্য

বিশেষত দক্ষিণ এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু দেশে মেয়েদের শিক্ষার হার খুবই কম।

৪. জলবায়ু পরিবর্তন

বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা ও অন্যান্য দুর্যোগ প্রতি বছর লাখো শিশুকে স্কুলে যেতে বাধা দেয়।

৫. অভিবাসন ও বাস্তুচ্যুতি

রোহিঙ্গা, সিরিয়ান শরণার্থীসহ বিশ্বে প্রায় ৪ কোটি শিশু বাস্তুচ্যুত জীবনযাপন করছে; তাদের বড় অংশই স্কুলের বাইরে।

৬. শিক্ষক সংকট ও দুর্বল অবকাঠামো

অনেক দেশে প্রয়োজনীয় শিক্ষক নেই, স্কুল নেই, পাঠ্যপুস্তক নেই—যা শিক্ষা ব্যাহত করছে।

শিক্ষাকে মানবিক দায়িত্ব হিসেবে দেখার আহ্বান

সম্মেলনের বক্তারা বলেন—
বিশ্বকে কে কোন দেশের নাগরিক, কে ধনী আর কে দরিদ্র—এসব দিয়ে নয়; সবাইকে ভবিষ্যতের মানুষ হিসেবে দেখতে হবে।

শিক্ষা কোনো প্রত্যাশা নয়—এটি একটি মানবিক দায়িত্ব।

একটি শিশু শিক্ষার সুযোগ না পেলে—

  • সে দারিদ্র্য থেকে বের হওয়ার সুযোগ হারায়
  • পরিবার উন্নতির পথ হারায়
  • সমাজ তার সৃষ্টিশীল শক্তিকে হারায়
  • একটি জাতি তার ভবিষ্যৎ নেতাকে হারায়

সিরিয়ার ফার্স্ট লেডির সঙ্গে বৈঠক—“বন্ধুত্বের বন্ধন আরও দৃঢ় হবে”

সম্মেলন শেষে আমিনা এরদোগান জানান—তিনি সিরিয়ার ফার্স্ট লেডির সঙ্গে একটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেছেন।

তিনি বলেন—

“অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় আমাদের বন্ধুত্বের বন্ধন আরও দৃঢ় হবে বলে আশা করি।”

এই বৈঠক মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি, শিক্ষা সহায়তা, মানবিক সহযোগিতা ও অভিন্ন ভবিষ্যৎ নির্মাণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

বিশ্বের শিক্ষাবঞ্চিত শিশু: সমাধান কোথায়?

সম্মেলনে উপস্থাপিত বিভিন্ন প্রতিবেদন ও আলোচনায় যে সমাধানগুলো উঠে এসেছে সেগুলো হলো—

১. জরুরি শিক্ষা তহবিল গঠন

সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে জরুরি ভিত্তিতে স্কুল পুনর্নির্মাণ, পাঠদান ও শিক্ষাসামগ্রী সরবরাহ করতে আন্তর্জাতিক তহবিল গড়ে তোলার প্রস্তাব এসেছে।

২. সরকার–বেসরকারি অংশীদারত্ব বৃদ্ধি

করপোরেট সেক্টর ও এনজিওগুলোকে শিক্ষা উন্নয়নে আরও যুক্ত করা দরকার।

৩. মেয়েদের শিক্ষা অগ্রাধিকার দেওয়া

মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করা গেলে এক প্রজন্মের দারিদ্র্য চক্র ভাঙা সম্ভব।

৪. নিরাপদ শিক্ষা পরিবেশ

যুদ্ধে বা দুর্যোগে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে শিশুদের জন্য নিরাপদ শিক্ষা কেন্দ্র তৈরি করা জরুরি।

৫. ডিজিটাল শিক্ষা বিস্তার

প্রযুক্তি–নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও সহজলভ্য করা দরকার যাতে দূরবর্তী এলাকার শিশুরাও মানসম্মত শিক্ষা পায়।

৬. শিক্ষক প্রশিক্ষণ

শিক্ষার মান উন্নয়নে প্রশিক্ষিত শিক্ষক অপরিহার্য।

শিক্ষা ছাড়া উন্নয়ন অসম্ভব—বিশেষজ্ঞদের মতামত

বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিবিদ, মানবাধিকার কর্মী ও শিক্ষাবিদদের মতে—শিক্ষাকে কেন্দ্র করেই একটি শক্তিশালী, সচেতন, মানবিক সমাজ গড়ে ওঠে।

শিক্ষা থাকলে—

  • সন্ত্রাস কমে
  • দারিদ্র্য হ্রাস পায়
  • অর্থনীতি শক্তিশালী হয়
  • প্রযুক্তির অগ্রগতি বাড়ে
  • স্বাস্থ্যব্যবস্থা উন্নত হয়
  • নারীর ক্ষমতায়ন দ্রুত বৃদ্ধি পায়
  • মানবাধিকার নিশ্চিত হয়

অন্যদিকে শিক্ষাবঞ্চনা থাকলে একটি দেশ কখনোই দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নে পৌঁছাতে পারে না।

তুরস্কের উদ্যোগ: বিশ্ব শিক্ষা সহযোগিতায় নতুন দিশা

মারিফ ফাউন্ডেশন গত কয়েক বছরে ৫০টিরও বেশি দেশে শিক্ষা সহায়তা প্রকল্প চালু করেছে।
তারা—

  • নতুন স্কুল নির্মাণ করছে
  • প্রশিক্ষণ দিচ্ছে
  • শিক্ষা–সামগ্রী বিতরণ করছে
  • শরণার্থী শিশুদের জন্য বিশেষ শিক্ষা কর্মসূচি চালু করেছে

তুরস্কের নেতৃত্বাধীন এই উদ্যোগ অনেক দেশেই শিক্ষাব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনছে।

বিশ্বের শিশুদের জন্য একত্রে কাজ করার আহ্বান

ইস্তাম্বুল শিক্ষা সম্মেলন শুধুমাত্র একটি অনুষ্ঠান নয়; এটি ছিল একটি মানবিক প্ল্যাটফর্ম যেখানে বিশ্বের উন্নতি, শান্তি ও সমতার কথা আলোচনা হয়েছে।

সম্মেলন শেষে একটি বার্তাই সবার মনে প্রতিধ্বনিত হয়েছে—

**প্রত্যেক শিশু শিক্ষার অধিকারী।

কোনো শিশু যেন অন্ধকারে হারিয়ে না যায়।
একটি শিশুকে শিক্ষা দেওয়া মানে পুরো পৃথিবীকে আলোকিত করা।**

বিশ্বে আজ ২৫ কোটি ১০ লাখ শিশুর মুখে শিক্ষা নেই।
তাদের চোখে স্বপ্ন নেই।
তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত।

এই শিশুরা যদি শিক্ষা না পায়—
তারা বড় হয়ে দারিদ্র্যের চক্র, সংঘাত এবং অনিরাপত্তার শিকার হবে।

ইস্তাম্বুল শিক্ষা সম্মেলন বিশ্বের সামনে সেই কঠিন সত্য আবারও তুলে ধরেছে।
এবং স্মরণ করিয়ে দিয়েছে—

শিক্ষা হলো মানবতার সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ।

বিশ্বের প্রতিটি দেশের দায়িত্ব—এই বিনিয়োগ নিশ্চিত করা।

MAH – 14152 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button