শিক্ষা

মুহাম্মাদ (সা.)-কে নিয়ে কটূক্তি; আজীবন বহিষ্কার জাবি শিক্ষার্থী

Advertisement

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাগুলোর একটি হলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী তৌফিক ইসলাম নাবিলের বিরুদ্ধে নেওয়া কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হযরত মুহাম্মাদ (সা.)–কে নিয়ে কটূক্তি ও অবমাননাকর মন্তব্য করার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে আজীবন বহিষ্কার করেছে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট।

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে নেওয়া এই সিদ্ধান্ত বর্তমানে দেশব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।

ঘটনাটি শুধু এক শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে নেওয়া শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নয়—এটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দায়িত্বহীন ও উস্কানিমূলক আচরণের পরিণতি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নীতি, শিক্ষাঙ্গনে সহনশীলতা, বাংলাদেশের আইন ও সমাজের প্রতিক্রিয়া—সবকিছুরই প্রতিচ্ছবি।

ঘটনার শুরু: একটি স্ক্রিনশটেই উত্তাল ক্যাম্পাস

২০২৫ সালের ২৮ জুন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ক্রিনশট ছড়িয়ে পড়ে।

স্ক্রিনশটটিতে দেখা যায়—তৌফিক ইসলাম নাবিল নামের একটি অ্যাকাউন্ট থেকে হযরত মুহাম্মাদ (সা.)–কে নিয়ে অবমাননাকর মন্তব্য করা হয়েছে।

এই পোস্টটি মুহূর্তেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে ক্ষোভ ছড়িয়ে দেয়। ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুভূতিকে আঘাত করার অভিযোগে শিক্ষার্থীরা কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাতে থাকে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের ছাত্রছাত্রীরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু করে এবং ক্যাম্পাসে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।

শিক্ষার্থীদের তীব্র প্রতিবাদ

স্ক্রিনশটটি প্রকাশ হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা দ্রুত সংগঠিত হয়।

  • অনেকে বিক্ষোভ মিছিল করে
  • বিভাগীয় শিক্ষক, প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ জমা পড়ে
  • ক্যাম্পাসে আলোচনায় বিষয়টি প্রধান ইস্যু হয়ে ওঠে

বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে ধর্মীয় অবমাননা সম্পর্কিত অভিযোগ পাওয়া গেলেও এবার ব্যাপক সামাজিক ও অনলাইন প্রতিক্রিয়া থাকায় শিক্ষার্থীদের চাপ দ্রুত বাড়তে থাকে।

শিক্ষার্থীরা মনে করে—
এ ধরনের মন্তব্য কেবল ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত নয়, বরং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুণ্ন করা।

প্রাথমিক ব্যবস্থা: সাময়িক বহিষ্কার ও তদন্ত কমিটি গঠন

২৮ জুন ঘটনাটি প্রকাশ হওয়ার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জরুরি বৈঠকে বসে।

৩০ জুন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নাবিলকে সাময়িক বহিষ্কার করে এবং একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে।

তদন্ত কমিটির কাজ ছিল—

  • অভিযোগের সত্যতা যাচাই
  • উক্ত অ্যাকাউন্টের প্রকৃত মালিকানা নিশ্চিত করা
  • উদ্দেশ্য, সময়, প্রেক্ষাপট খতিয়ে দেখা
  • বিশ্ববিদ্যালয়ের আচরণবিধি অনুযায়ী উপযুক্ত শাস্তির সুপারিশ করা

ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের এই পদক্ষেপ শিক্ষার্থীদের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি আনলেও অনেকে আরও কঠোর শাস্তির দাবিতে ছিলেন।

তদন্ত কমিটির পর্যবেক্ষণ: অভিযোগ প্রমাণিত

তদন্ত কমিটি বিস্তারিত তদন্তের পর তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়—

  • স্ক্রিনশটে পাওয়া মন্তব্য নাবিলের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকেই করা
  • মন্তব্যটি ধর্মীয় বিশ্বাসকে আঘাত করে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা বিধি লঙ্ঘনকারী
  • শিক্ষার্থী হিসেবে নাবিল দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ করেছে
  • এই কাজের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে

তদন্ত প্রতিবেদনে তৌফিক ইসলাম নাবিলকে আজীবন বহিষ্কারের সুপারিশ করা হয়।

ডিসিপ্লিনারি বোর্ড ও সিন্ডিকেট: সর্বোচ্চ শাস্তির সিদ্ধান্ত

তদন্ত কমিটির সুপারিশ পেয়ে ডিসিপ্লিনারি বোর্ড বিষয়টি পুনরায় পর্যালোচনা করে।

ডিসিপ্লিনারি বোর্ডও সর্বোচ্চ শাস্তি বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নেয় এবং তা সিন্ডিকেটে প্রেরণ করে।

৪ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেট সভায় বিষয়টি নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়।

অবশেষে ৫ ডিসেম্বর সিন্ডিকেট সর্বসম্মতভাবে নাবিলকে আজীবন বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

৬ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার আজিজুর রহমান সিদ্ধান্তটি গণমাধ্যমকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করেন।

কেন এত কঠোর শাস্তি? বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাখ্যা

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানিয়েছে—

  1. ধর্মীয় অবমাননা বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ
  2. এটি ক্যাম্পাসের শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করেছে
  3. শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে
  4. বিশ্ববিদ্যালয় পরিবেশ নিরাপত্তার স্বার্থে কঠোর শাস্তি প্রয়োজন
  5. ভবিষ্যতে কেউ যেন এ ধরনের অপরাধে উৎসাহিত না হয়, তার জন্য উদাহরণ সৃষ্টি করা জরুরি

প্রশাসনের ভাষায়,
“এ ধরনের মন্তব্য সমাজে সহিংসতা ও বিভাজন তৈরি করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় এমন আচরণ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না।”

অধিকতর প্রেক্ষাপট: বাংলাদেশে ধর্মীয় অবমাননা সংবেদনশীল ইস্যু

বাংলাদেশে ধর্মীয় মূল্যবোধ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

আইনেও রয়েছে—

  • তথ্যপ্রযুক্তি আইন
  • ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন
  • দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারা

যেখানে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার অভিযোগে শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ধর্মীয় ব্যঙ্গ বা কটূক্তি জনমনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশজুড়ে এমন অনেক ঘটনা আলোচিত হয়েছে, যেখানে—

  • সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের পোস্ট
  • মন্তব্য বা স্ট্যাটাস
    মানুষের ওপর আক্রমণ, সহিংসতা বা আইনগত ব্যবস্থা ডেকে এনেছে।

এই বাস্তবতার আলোকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সিদ্ধান্ত অনেকের কাছে যৌক্তিক বলে মনে হয়েছে।

শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া

এই সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর ক্যাম্পাসে সাধারণত স্বস্তি দেখা যায়।
অনেক শিক্ষার্থী মনে করেন—

  • ধর্মীয় অবমাননার বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়কে কঠোর অবস্থান নিতে হবে
  • এটি ভবিষ্যতের জন্য বার্তা
  • ক্যাম্পাসে সুশৃঙ্খল পরিবেশ বজায় রাখতে প্রশাসন দায়িত্বশীল ভূমিকা নিয়েছে

কিছু মানবাধিকারকর্মী অবশ্য ‘আজীবন বহিষ্কার’কে কঠোর শাস্তি বলে মন্তব্য করেছেন। তাদের মতে,
“কেউ ভুল করলে শোধরানোর সুযোগ থাকা উচিত।”

অন্যদিকে, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতপ্রাপ্ত অনেকে এর চেয়ে কম শাস্তিকে অযৌক্তিক মনে করতেন।

ফলে দুই ধরনের মতামত দেখা গেলেও সামগ্রিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রদায় সিদ্ধান্তটিকে সমর্থন করেছে।

বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অনলাইন আচরণবিধি: কেন কঠোরতা বাড়ছে

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের অনলাইন আচরণ বিষয়ে কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন করছে।
কারণ—

  • ফেসবুক, টিকটক, এক্স, ইনস্টাগ্রামসহ প্ল্যাটফর্মগুলোতে শিক্ষার্থীদের মন্তব্য দ্রুত ভাইরাল হয়
  • একটি পোস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ক্ষুণ্ন করতে পারে
  • ধর্মীয়, রাজনৈতিক বা উস্কানিমূলক মন্তব্য সহিংসতার ঝুঁকি বাড়ায়
  • অনলাইন পরিচয় বাস্তব জীবনে শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা ও দায়িত্বজ্ঞানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে

এ কারণে প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, রাবি, চবি সহ—কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে।

জাবি প্রশাসনও সেই ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বক্তব্য: রেজিস্ট্রারের ব্যাখ্যা

ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার আজিজুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন—

“সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অবমাননাকর মন্তব্যের ঘটনাটি আমাদের নজরে আসার পরপরই জরুরি বৈঠকে বসে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সিন্ডিকেট আজীবন বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত দিয়েছে।”

তিনি আরও জানান—

  • বিশ্ববিদ্যালয়ের কোড অব কন্ডাক্ট অনুযায়ী ধর্মীয় অবমাননা গুরুতর অপরাধ
  • এই শাস্তি ভবিষ্যতে সবাইকে দায়িত্বশীল হতে শিখাবে

এ ঘটনা বাংলাদেশের তরুণ সমাজকে কী বার্তা দিল

ঘটনাটি শুধু জাবির একজন শিক্ষার্থীর শাস্তিই নয়—সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।

বার্তাটি হলো—

  1. অনলাইনে যা লেখা হয়, তার দায়ভার বাস্তব জীবনে বহন করতে হয়
  2. ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করলে আইনগত পরিণতি অত্যন্ত কঠিন হতে পারে
  3. বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সামাজিক মূল্যবোধ সম্মান করতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করছে
  4. এক মুহূর্তের ভুলে আজীবন ক্যারিয়ার নষ্ট হতে পারে

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী তৌফিক ইসলাম নাবিলকে হযরত মুহাম্মাদ (সা.)–কে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে আজীবন বহিষ্কারের ঘটনা বাংলাদেশে শিক্ষা, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের গুরুত্ব নতুন করে সামনে এনে দিয়েছে।

এই সিদ্ধান্ত—

  • বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কঠোর অবস্থান
  • ধর্মীয় সংবেদনশীলতার প্রতি সম্মান
  • অনলাইনে দায়িত্বশীল আচরণের প্রয়োজনীয়তা
  • শিক্ষাঙ্গনে শৃঙ্খলা বজায় রাখার দৃঢ়তা

সবকিছুরই সমন্বিত দৃষ্টান্ত।

এটি তরুণ সমাজের জন্য একটি বড় শিক্ষা—
অনলাইনে কোনো মন্তব্য করার আগে তার সামাজিক, ধর্মীয় ও আইনি প্রভাব সম্পর্কে সচেতন থাকা অত্যন্ত জরুরি।

MAH – 14151 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button