প্রযুক্তি

মেটার ‘ফিনিক্স’ মিক্সড রিয়েলিটি চশমার উদ্বোধন পিছিয়ে গেল

Advertisement

বিশ্ব প্রযুক্তি বাজারে মেটার নতুন প্রজন্মের মিক্সড রিয়েলিটি ডিভাইস ‘ফিনিক্স’ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই গুঞ্জন। প্রথমে ধারণা করা হচ্ছিল, ২০২৬ সালের দ্বিতীয়ার্ধেই ডিভাইসটি বাজারে চলে আসবে। কিন্তু মেটা এবার আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে, প্রকল্পটি সম্পূর্ণ নিখুঁত না হওয়া পর্যন্ত তারা উদ্বোধন করতে রাজি নয়। ফলে নতুন তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে—২০২৭ সালের প্রথম ছয় মাস।

এই ঘোষণার পর প্রযুক্তিপ্রেমীদের মাঝে হতাশার পাশাপাশি নতুন কৌতূহলও তৈরি হয়েছে—কি এমন ঘটল যে, মেটা তাদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও উচ্চাভিলাষী ডিভাইসটির বাজারযাত্রা পিছিয়ে দিল?

সময়সূচি কেন পেছাল?—অভ্যন্তরীণ চিঠিতে স্পষ্ট ব্যাখ্যা

মেটার রিয়েলিটি ল্যাবস ফাউন্ডেশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাহের সাবা কর্মীদের উদ্দেশে পাঠানো এক অভ্যন্তরীণ চিঠিতে জানান, প্রকল্পটির বেশ কিছু অংশ প্রত্যাশার চেয়ে বেশি জটিল হয়ে গেছে। বিশেষ করে—

  • হাই-রেজল্যুশন পাসথ্রু ক্যামেরা
  • উন্নত সেন্সর সিস্টেম
  • নতুন ইন্টিগ্রেটেড এআই ক্ষমতা
  • অতিরিক্ত হালকা গঠন এবং তাপ নিয়ন্ত্রণ

এসব প্রযুক্তি একসঙ্গে এক ডিভাইসে স্থাপন করতে গিয়ে প্রকল্পের সময়সীমা স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে গেছে।

আরেক নোটে মেটার মেটাভার্স ডিভিশনের দুই শীর্ষ কর্মকর্তা গ্যাব্রিয়েল অউলরায়ান কেয়ার্নস লিখেছেন—

“বেশ কিছু উন্নত ফিচার একই সঙ্গে তৈরি হচ্ছে। ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতার সঙ্গে কোনো আপস করা যাবে না। তাই সময় বাড়ানো অপরিহার্য।”

তাদের মতে, ‘ফিনিক্স’ এমন একটি ডিভাইস যার মাধ্যমে মেটা স্মার্টগ্লাস ইকোসিস্টেমকে নতুন এক যুগে নিয়ে যেতে চায়। ফলে তাড়াহুড়ো করে বাজারে নিয়ে আসার পরিবর্তে নিখুঁত ও নির্ভরযোগ্য ডিভাইসই তাদের প্রধান লক্ষ্য।

ডিভাইসের নকশা: অ্যাপলের ভিশন প্রোর হালকা প্রতিদ্বন্দ্বী?

অভ্যন্তরীণ একাধিক কর্মী, যারা প্রকৃত ডিভাইসটি দেখেছেন এবং নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, জানিয়েছেন—

  • ফিনিক্স দেখতে অনেকটা গগলস-সদৃশ
  • নকশায় অ্যাপলের Vision Pro–এর কিছু অনুপ্রেরণা রয়েছে
  • তবে Vision Pro–এর তুলনায় এটি অনেক হালকা
  • ডিভাইসের সঙ্গে একটি আলাদা পাওয়ার প্যাক বা “পাক” থাকবে
  • শক্তিশালী প্রসেসিংয়ের সময়ে গরম না হওয়ার লক্ষ্যেই এই পাওয়ার প্যাক আলাদা রাখা হয়েছে

এ ধরনের ডিজাইন মেটার পূর্ববর্তী “Project Aria” ও “Quest Pro”–র পরীক্ষামূলক ধারণার উন্নত সংস্করণ বলেই বিশ্লেষকদের মত।

মার্ক জুকারবার্গের সরাসরি নির্দেশনা

মাহের সাবা তার চিঠিতে আরও জানিয়েছেন, সম্প্রতি মেটার সিইও মার্ক জুকারবার্গ রিয়েলিটি ল্যাবস টিমের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে জুকারবার্গ বলেন—

  • “গতি নয়, গুণগত মানই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।”
  • স্থায়ী ব্যবসায়িক কাঠামো নিশ্চিত না হলে ডিভাইস আনলে কোনো লাভ নেই
  • যেসব দল কাজ করছে তাদের সময়সূচি পরিবর্তন করতে হতে পারে
  • সময় বাড়ানো মানে নতুন ফিচার নয়, বরং পূর্বের পরিকল্পনাকেই নিখুঁত করা

জুকারবার্গ দীর্ঘদিন ধরেই মেটার AR/VR ভবিষ্যৎ নিয়ে কাজ করছেন। Quest সিরিজের সাফল্যকে ভিত্তি করে এখন তিনি এমন একটি মিক্সড রিয়েলিটি চশমা চান যা—

“দিনভর পরা যাবে, স্মার্টফোনের বিকল্প হবে, আর AI–কে সামনে নিয়ে যাবে।”

মেটার মেগা–ইকোসিস্টেম পরিকল্পনা: ‘ফিনিক্স’ শুধু শুরু

ফিনিক্স পিছিয়ে গেলেও মেটার অন্যান্য ওয়্যারেবল প্রকল্প থেমে নেই। বরং পুরো ইকোসিস্টেমকে আরও বিস্তৃত করা হচ্ছে।

১) ২০২৬ সালে আসছে ‘মালিবু ২’

এটি সীমিত সংস্করণের একটি ওয়্যারেবল ডিভাইস। যদিও বিস্তারিত প্রকাশ করেনি মেটা, তবে ধারণা করা হচ্ছে—

  • এটি হয়তো উন্নত স্মার্টগ্লাস
  • অথবা এআই–চালিত ব্যক্তিগত অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিভাইস
  • অথবা XR এবং AI মিলিয়ে একটি পরীক্ষামূলক ওয়্যারেবল প্ল্যাটফর্ম

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মালিবু ২–এর মাধ্যমে মেটা ভবিষ্যতের চশমাগুলোর সফটওয়্যার ভিত্তি পরীক্ষা করতে চায়।

২) নতুন জেনারেশনের Quest হেডসেট

গ্যাব্রিয়েল অউল ও কেয়ার্নস জানিয়েছেন, নতুন Meta Quest পুরোপুরি গেমিং ও ইমারসিভ অভিজ্ঞতার জন্য তৈরি হবে।

প্রতিশ্রুত উন্নয়নগুলো—

  • অনেক হালকা বডি
  • শক্তিশালী প্রসেসিং ও গ্রাফিক্স
  • বাস্তবসম্মত হ্যান্ড–ট্র্যাকিং
  • নতুন কন্ট্রোলার ডিজাইন
  • খরচ কমাতে সম্পূর্ণ নতুন ইঞ্জিনিয়ারিং নকশা

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নতুন Quest বাজারে এলে এটি PSVR2 বা HTC Vive–এর সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবে।

ফিনিক্স: মেটার স্বপ্নের ডিভাইস

বিগত কয়েক বছর ধরে মেটা যে নতুন যুগের ইন্টারনেট—মেটাভার্স—নির্মাণে কাজ করছে, তার কেন্দ্রীয় ডিভাইস হতে পারে ‘ফিনিক্স’। ধারণা করা হচ্ছে:

► সম্ভাব্য বৈশিষ্ট্যসমূহ (টেক রিপোর্টে উল্লেখিত)

  • উচ্চ–গুণমানের রঙিন পাসথ্রু
  • বাস্তব ও ভার্চুয়াল পরিবেশের সুনিপুণ মিশ্রণ
  • কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা–চালিত ডিজিটাল অ্যাসিস্ট্যান্ট
  • 3D অবজেক্ট ম্যানিপুলেশন
  • অতি হালকা ফাইবার–কম্পোজিট বডি
  • উন্নত পরিবেশ সেন্সিং
  • জেসচার–ভিত্তিক কন্ট্রোল
  • বুদ্ধিমান চোখ–ট্র্যাকিং

► সম্ভাব্য ব্যবহার

  • ভার্চুয়াল মিটিং
  • 3D ডিজাইন ও আর্কিটেকচার
  • স্বাস্থ্যসেবা ট্রেনিং
  • শিক্ষায় ইন্টারঅ্যাকটিভ ক্লাসরুম
  • কোডিং, কনটেন্ট ক্রিয়েশন
  • স্মার্ট–ওয়ার্কস্টেশন

মেটা আশা করছে, ভবিষ্যতে এই ডিভাইসটি এমন হবে যে ব্যবহারকারীরা ফোনের চেয়ে বেশি সময় এটি পরেই কাটাতে পারবেন।

প্রযুক্তি বাজারে প্রভাব: বিশ্লেষকদের দৃষ্টিভঙ্গি

১) প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকবে অ্যাপল

অ্যাপল তাদের Vision Pro–এর দ্বিতীয় প্রজন্মের কাজ ইতোমধ্যে শুরু করে দিয়েছে। মেটা পিছিয়ে যাওয়ায় অ্যাপলের জন্য বাজারে সুবিধা মিলতে পারে।

২) স্যামসাং–গুগলের XR হেডসেট তাড়াতাড়ি আসতে পারে

Samsung–Google–Qualcomm যৌথভাবে যে প্রিমিয়াম XR হেডসেট ২০২৬ এ আনার কথা বলেছে, সেটি সময়মতো এলে বাজার প্রতিযোগিতা বাড়বে।

৩) মিক্সড রিয়েলিটি বাজার দ্রুত বাড়ছে

বিশ্বব্যাপী চাহিদা বাড়ছে—

  • গেমিং–এ
  • কর্মক্ষেত্রে
  • শিক্ষায়
  • ভার্চুয়াল কনটেন্ট তৈরিতে

মেটা তাই চায় তাদের ফিনিক্স ডিভাইসটি “ট্রেন্ডসেটার” হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হোক, শুধুমাত্র আরেকটি হেডসেট হিসেবে নয়।

মেটার আর্থিক প্রেক্ষাপট: রিয়েলিটি ল্যাবসের উচ্চ ব্যয়

রিয়েলিটি ল্যাবস বিভাগ ২০২০ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে বছরে কয়েক বিলিয়ন ডলার লোকসান দেখাচ্ছে। তবে মেটা এটিকে বিনিয়োগ হিসেবেই দেখছে—ঠিক যেমন ২০০৮–২০১২ সালে মোবাইল অ্যাপ ইকোসিস্টেম তৈরি করেছিল।

অর্থ বিশেষজ্ঞরা বলছেন—

  • মেটা এখন দ্রুত নয়, স্থায়ী ভবিষ্যৎ–নির্ভর ডিভাইস তৈরি করতে চায়
  • ফিনিক্সই হয়তো হবে তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ডিভাইস
  • সময়সীমা বাড়ানো আর্থিকভাবে ভালো সিদ্ধান্ত

ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা: কী ঘোষণা আসতে পারে?

অনেক প্রযুক্তিবিদ মনে করছেন, ২০২৬ সালের Meta Connect ইভেন্টেই ‘ফিনিক্স’-এর চূড়ান্ত ডেমো দেখাতে পারে মেটা। তবে বাজারে আসবে ২০২৭–এ।

সম্ভাব্য ঘোষণার মধ্যে থাকতে পারে—

  • মালিবু ২–এর পূর্ণ বিবরণ
  • ফিনিক্স সফটওয়্যার প্ল্যাটফর্ম
  • নতুন এআই অ্যাসিস্ট্যান্ট
  • ডেভেলপারদের জন্য ওপেন XR টুলস
  • নতুন Quest হেডসেটের লঞ্চ তারিখ

সবকিছু মিলিয়ে: ফিনিক্স কি মেটাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে?

মেটা তাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে AI + Mixed Reality ইকোসিস্টেমের ওপর। স্মার্টগ্লাস, Quest হেডসেট, মেটাভার্স সফটওয়্যার প্ল্যাটফর্ম—সবকিছুকে একসঙ্গে বেঁধে নতুন বিশ্ব তৈরি করতে চায় তারা।

ফিনিক্স যদি সফল হয়—

  • স্মার্টফোন–পরবর্তী যুগের পথিকৃত হতে পারে
  • নতুন ডিজিটাল ওয়ার্কস্পেসের জন্ম দেবে
  • প্রতিযোগীরা (Apple, Samsung, Google) আরও চাপ অনুভব করবে
  • মেটার আর্থিক কাঠামো নতুনভাবে দাঁড়াতে পারে

তবে যদি ব্যর্থ হয়—

  • মেটার বহু বছরের বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়তে পারে
  • প্রযুক্তি বাজারে তাদের নেতৃত্ব কমে যেতে পারে

তাই মেটা চায়, “ফিনিক্স হোক নিখুঁত—সময়ের আগে নয়।”

মেটার ‘ফিনিক্স’ মিক্সড রিয়েলিটি চশমার বাজারযাত্রা পিছিয়ে গেলেও প্রযুক্তি বিশ্বে এটি নিয়ে উত্তেজনা কমেনি। বরং নতুন তারিখ, নতুন প্রত্যাশা এবং আরও উন্নত ডিজাইনের সম্ভাবনা প্রযুক্তিবিদ ও ব্যবহারকারীদের কাছে বিষয়টিকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে।

এখন শুধু অপেক্ষা—২০২৭ সালে মেটা আসলে কী নিয়ে হাজির হয়।

MAH – 14137 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button