বাংলাদেশ

কৃষি জমিতে কাজ করছিল বাংলাদেশি যুবক, এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে বিএসএফ

Advertisement

মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার কর্মধা ইউনিয়নের সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে শুকুরাম উরাং নামে এক বাংলাদেশি যুবক নিহত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) দুপুর দেড়টার দিকে সীমান্তবর্তী ১৮৪৪ নং পিলারের পাশে এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। স্থানীয় পুলিশ জানিয়েছে, নিহত যুবক শুকুরাম উরাং যখন তাঁর কৃষি জমিতে কাজ করছিলেন, ঠিক তখনই ভারতীয় বিএসএফ সদস্যরা তাঁকে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। এই ঘটনা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ‘জিরো কিলিং’ নীতি লঙ্ঘনের আরেকটি উদ্বেগজনক দৃষ্টান্ত স্থাপন করল।

হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত: কৃষি জমিতে গুলি

কুলাউড়া উপজেলার কর্মধা ইউনিয়নের মুরইছড়া চা-বাগান বস্তি এলাকার বাসিন্দা দাসনু উরাংয়ের পুত্র শুকুরাম উরাং (বয়স আনুমানিক ৩০ বছর) প্রতিদিনের মতো বৃহস্পতিবার দুপুরে সীমান্তবর্তী এলাকায় তাঁদের কৃষি জমিতে কাজ করতে যান। তাঁর কাজ করার স্থানটি ১৮৪৪ নং সীমান্ত পিলারের খুব কাছাকাছি।

কুলাউড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওমর ফারুক জানান, দুপুর দেড়টার দিকে ভারতীয় বিএসএফ সদস্যরা শুকুরাম উরাংকে লক্ষ্য করে কোনো প্রকার সতর্কতা ছাড়াই এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। গুলিবিদ্ধ হয়ে শুকুরাম উরাং দৌড়ে কিছু দূর এগিয়ে এসে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। স্থানীয়রা দ্রুত তাঁকে উদ্ধার করে কুলাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। কৃষি জমিতে কাজ করা একজন নিরীহ নাগরিককে গুলি করে হত্যার ঘটনায় এলাকায় স্থানীয়দের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও আতঙ্ক বিরাজ করছে।

পুলিশের আইনি পদক্ষেপ ও তদন্ত

নিহত শুকুরাম উরাংয়ের লাশ কুলাউড়া সদর হাসপাতালে সুরতহাল শেষে ময়নাতদন্তের জন্য মৌলভীবাজার জেলা হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ করা হয়েছে। এই ঘটনায় কুলাউড়া থানায় একটি হত্যা মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে।

কুলাউড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওমর ফারুক বলেন, ‘শুকুরাম উরাং তাদের কৃষি জমিতে কাজ করতে গিয়েছিলেন। বিএসএফ সদস্যরা কেন তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছে, সেই বিষয়ে তদন্ত চলছে।’ পুলিশ ঘটনার প্রকৃত কারণ জানতে এবং বিএসএফের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবিও বিএসএফের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছে।

সীমান্ত হত্যার পূর্বপটভূমি ও জিরো কিলিং নীতি

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনা প্রায়শই ঘটে থাকে। যদিও ভারত সরকার এবং বিএসএফ বারবার সীমান্তে ‘জিরো কিলিং’ নীতি মেনে চলার অঙ্গীকার করেছে, তবুও এই ধরনের হত্যাকাণ্ড বন্ধ হচ্ছে না। কিছুদিন আগেই চুয়াডাঙ্গা সীমান্তেও বিএসএফের গুলিতে এক বাংলাদেশি যুবক নিহত হন।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সীমান্তে বিএসএফ প্রায়শই চোরাচালান বা অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে গুলি চালায়, কিন্তু শুকুরাম উরাংয়ের ক্ষেত্রে তিনি তাঁর নিজের কৃষি জমিতে কাজ করছিলেন। এই ঘটনা প্রমাণ করে, বিএসএফ অনেক সময় অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করে এবং নিরপরাধ মানুষকেও লক্ষ্যবস্তু বানায়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোও এই ধরনের হত্যাকাণ্ড নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

চা-বাগান বস্তি ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা

নিহত শুকুরাম উরাং কর্মধা ইউনিয়নের মুরইছড়া চা-বাগান বস্তি এলাকার বাসিন্দা। এই বস্তি এলাকায় মূলত আদিবাসী জনগোষ্ঠী বা চা শ্রমিকরা বসবাস করেন। সীমান্তবর্তী এলাকায় এই আদিবাসী ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী প্রায়শই বিএসএফের আগ্রাসন ও সহিংসতার শিকার হন।

তাঁরা জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে সীমান্তবর্তী কৃষি জমিতে কাজ করতে বাধ্য হন। এই হত্যার ঘটনা চা-বাগান বস্তির বাসিন্দাদের মধ্যে আরও বেশি ভীতি ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করবে। স্থানীয় প্রশাসন এবং জনপ্রতিনিধিদের উচিত, এই নিরীহ জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং বিএসএফের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ জানানো।

বিজিবি-বিএসএফের পতাকা বৈঠক ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা

এই ধরনের সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিবি) এবং বিএসএফের মধ্যে পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বিজিবি এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানাবে এবং ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্তের দাবি জানাবে।

বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কূটনৈতিকভাবে এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানানো এবং বিএসএফের ওপর ‘জিরো কিলিং’ নীতি কঠোরভাবে মেনে চলার জন্য চাপ সৃষ্টি করা জরুরি। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যেকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে হলে সীমান্তে এই ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত হত্যাকাণ্ড অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।

কৃষকের নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচারের দাবি

মৌলভীবাজারের কুলাউড়া সীমান্তে কৃষি জমিতে কাজ করা শুকুরাম উরাংকে বিএসএফের এলোপাতাড়ি গুলিতে হত্যার ঘটনাটি একটি মর্মান্তিক ও অমানবিক অপরাধ। জিরো কিলিং নীতির লঙ্ঘনকারী এই হত্যাকাণ্ডের পূর্ণাঙ্গ এবং নিরপেক্ষ তদন্ত এবং দোষী বিএসএফ সদস্যদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। নিহত শুকুরাম উরাংয়ের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং ভবিষ্যতে সীমান্তে নিরীহ কৃষকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।

এম আর এম – ২৫০৬, Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button