আবহাওয়া

চীনের জিনজিয়াংয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্পে কেঁপে উঠল সীমান্ত অঞ্চল

Advertisement

চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জিনজিয়াং প্রদেশ আবারও তীব্র ভূমিকম্পে কেঁপে উঠেছে। বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় দুপুরে ৬ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পটি আঘাত হানলে অল্প সময়ের জন্য আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সীমান্তবর্তী আকচি কাউন্টি ও আশপাশের বিভিন্ন অঞ্চলে। ভূমিকম্পের ঘটনা নিশ্চিত করেছে চীনের সরকারি গণমাধ্যম সিনহুয়া এবং দেশটির ভূকম্পন দপ্তর সিইএনসি (চায়না আর্থকোয়েক নেটওয়ার্কস সেন্টার)।

সিনহুয়ার তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি বা প্রাণহানির কোনো খবর পাওয়া যায়নি। তবে ভূমিকম্পের পরপরই জরুরি সাড়া টিম ঘটনাস্থলে কাজ শুরু করেছে এবং গুরুত্বপূর্ণ সব অবকাঠামো দ্রুত পরিদর্শন করা হচ্ছে।

ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ও গভীরতা

চীনের সিইএনসি জানিয়েছে, ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল জিনজিয়াংয়ের দক্ষিণাঞ্চলীয় আকচি কাউন্টির নিকটবর্তী এলাকায়, ভূপৃষ্ঠের প্রায় ১০ কিলোমিটার গভীরে
মাপা স্থানাঙ্ক ছিল —
অক্ষাংশ: ৪১.১৩° উত্তর
দ্রাঘিমাংশ: ৭৮.৪০° পূর্ব

স্থানীয় সময় দুপুর ৩টা ৪৪ মিনিটে ভূকম্পনটি অনুভূত হয়। কম গভীরতার হওয়ায় ভূমিকম্পটি শক্তিশালী ঝাঁকি সৃষ্টি করে। কম গভীরতার ভূমিকম্প সাধারণত বেশি ক্ষতি করতে পারে, তবে সৌভাগ্যবশত এলাকাটি ছিল তুলনামূলকভাবে কম জনবহুল।

আকচি কাউন্টিতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক

সিনহুয়ার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে—

  • সব জেলার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক
  • বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘ্ন ঘটেনি
  • মোবাইল ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা সচল
  • স্থানীয় প্রশাসন ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে মাঠ পর্যায়ে টিম পাঠিয়েছে

চীনের পশ্চিমাঞ্চলের পাহাড়ি অঞ্চলে ভূমিকম্প প্রায় নিয়মিত বিষয় হলেও অবকাঠামোগত প্রস্তুতির কারণে সাধারণত বড় ধরনের ক্ষতি কম হয়।

কিরগিজস্তান–জিনজিয়াং সীমান্তেও ভূকম্পন অনুভূত

ভূমিকম্পটি চীন সীমান্ত ছাড়িয়ে কিরগিজস্তান পর্যন্ত অনুভূত হয়। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে ঘরবাড়ি কেঁপে ওঠে এবং মানুষ আতঙ্কে রাস্তায় বের হয়ে আসে।
সাংহাই ডেইলির তথ্য অনুযায়ী, আকচি কাউন্টি সীমান্তবর্তী হওয়ায় ভূমিকম্পের অভিঘাত কিছুটা বেশি অনুভূত হয়।

জিনজিয়াং: ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল

চীনের জিনজিয়াং প্রদেশটি বিশ্বের অন্যতম সক্রিয় ফল্ট লাইনের ওপর অবস্থিত। ভারতীয় টেকটোনিক প্লেটের উত্তরের দিকে ধাক্কা এবং ইউরেশিয়ান প্লেটের সঙ্গে সংঘর্ষের কারণে এই অঞ্চলে ভূমিকম্পের ঝুঁকি অনেক বেশি।

বিশেষজ্ঞরা বলেন—

  • প্রতি বছর এই অঞ্চলে বড় ও মাঝারি ধরনের শতাধিক ভূমিকম্প ঘটে
  • হিমালয় অঞ্চল থেকে শুরু করে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত একটি বিশাল ফল্ট লাইন এই এলাকায় সক্রিয়
  • ভূমিকম্প সাধারণত ক্ষুদ্রতার হলেও মাঝে মাঝে ৬ থেকে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প দেখা যায়

২০১৬ সালে জিনজিয়াংয়ে ৬.৫ মাত্রার ভূমিকম্পে বেশ কয়েকজন মারা যায় এবং বহু ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০২১ সাল, ২০২৩ সাল এবং ২০২৪ সালেও এ অঞ্চলে বেশ কয়েকটি মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প ঘটে।

ভূমিকম্পের জেরে আতঙ্ক, তবে প্রস্তুত চীনা প্রশাসন

চীনের জরুরি ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আকচি অঞ্চলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। প্রশাসন দ্রুত—

  • উদ্ধারকারী দল মোতায়েন
  • স্থানীয় হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত রাখা
  • ঝুঁকিপূর্ণ ভবন পরীক্ষা
  • স্কুল, প্রশাসনিক ভবন, বাজার এলাকা পরিদর্শন

—এসব কার্যক্রম চালাচ্ছে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের কেউ কেউ জানিয়েছেন, প্রথমদিকে কম্পন এতটাই তীব্র ছিল যে ঘরবাড়ির জানালা কেঁপে উঠেছিল। তবে সড়ক ও ভবনগুলো দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।

চীনে বারবার ভূমিকম্প—এর কারণ কী?

চীন মূলত তিনটি বড় টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত হওয়ায় দেশটি প্রকৃতিগতভাবেই ভূমিকম্পপ্রবণ।

প্রধান কারণগুলো—

  1. ইউরেশিয়ান ও ভারতীয় প্লেটের সংঘর্ষ
  2. তিব্বত মালভূমির ধীরে ধীরে উত্তরমুখী চাপ সৃষ্টি
  3. কেন্দ্রীয় এশিয়ার সক্রিয় ফল্ট লাইন
  4. অ্যানাতোলিয়ান ও পাক-ইরান ফল্ট সিস্টেমের প্রভাব

এর ফলে চীনের সিচুয়ান, গ্যানসু, ইউনান ও জিনজিয়াং অঞ্চল প্রায়ই কম্পিত হয়।

পূর্বের বড় ভূমিকম্প যা ইতিহাসে রয়ে গেছে

২০০৮ সালের সিচুয়ান ভূমিকম্প

চীনের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ ভূমিকম্প। ৭.৯ মাত্রার এই ভূমিকম্পে প্রায় ৭০ হাজার মানুষ নিহত হয়।

১৯৯৬ সালের জিনজিয়াং ভূমিকম্প

জিনজিয়াংয়ে ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্পে বেশ কয়েক ডজন মানুষের মৃত্যু হয়।

২০২১–২০২৪: একের পর এক মাঝারি ভূমিকম্প

জিনজিয়াংয়ের পার্বত্য এলাকায় প্রায়ই ৫–৬ মাত্রার ভূমিকম্প ঘটে।

বর্তমান ভূমিকম্পটি তুলনামূলকভাবে সমান মাত্রার হলেও ক্ষয়ক্ষতির পরিধি এই মুহূর্তে কম বলে মনে হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ

চীনা ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ দাই শিয়াওওয়ে জানিয়েছেন—

“১০ কিলোমিটার গভীরতার ভূমিকম্প সাধারণত বেশি অনুভূত হয়। তবে এ অঞ্চলে ভবন নির্মাণে আধুনিক নিয়ম অনুসরণ করা হয় বলে ক্ষতি কম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।”

তবে তিনি সতর্ক করেছেন যে একই অঞ্চলে আফটারশক হতে পারে। এর মধ্যে কিছু কম্পন মাঝারি মাত্রারও হতে পারে, তাই বাসিন্দাদের সতর্ক থাকা প্রয়োজন।

ভূমিকম্পের পর যা করা হয়েছে

জরুরি সিদ্ধান্ত

  • রাস্তা ও সেতু পরীক্ষা
  • গ্যাস লাইনের নিরাপত্তা নিশ্চিত
  • সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্ত ভবন খালি করা
  • পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধসের ঝুঁকি পর্যবেক্ষণ
  • স্থানীয় গণমাধ্যমে সতর্কবার্তা সম্প্রচার

চীনের পশ্চিমাঞ্চলে শীতকালীন কঠোর আবহাওয়ার কারণে উদ্ধার কাজের ক্ষেত্রে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি হয়ে পড়ে। তবে এই মুহূর্তে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে জানিয়েছে প্রশাসন।

আন্তর্জাতিক নজর ও সীমান্তবর্তী দেশের সতর্কতা

এ ভূমিকম্পটি কিরগিজস্তান সীমান্তের কাছাকাছি হওয়ায় দেশটিও সতর্ক অবস্থানে গেছে।
কিরগিজস্তানের ভূকম্পন দপ্তর জানিয়েছে—

  • বেশ কয়েকটি এলাকায় হালকা কম্পন অনুভূত
  • কোনো ক্ষতি হয়নি
  • সীমান্ত এলাকায় নজরদারি বাড়ানো হয়েছে

মধ্য এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলো প্রায়ই একে অপরের ভূকম্পনে প্রভাবিত হয় কারণ পুরো অঞ্চলটি এক বিশাল ভূকম্পন সক্রিয় এলাকার ওপর অবস্থিত।

স্থানীয় মানুষের প্রতিক্রিয়া

আকচি কাউন্টির কয়েকজন বাসিন্দা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন—

  • প্রথম ধাক্কাটি ছিল প্রবল
  • দোকানপাটের কাচ কেঁপে ওঠে
  • ঘর থেকে বের হয়ে নিরাপদ স্থানে যেতে হয়
  • কিছু এলাকায় কয়েক সেকেন্ড ধরে কম্পন ছিল

তবে দ্রুতই পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে।

চীনের উন্নত ভূমিকম্প সতর্কতা ব্যবস্থা

চীনের ভূমিকম্প সতর্কতা ব্যবস্থা পৃথিবীর অন্যতম আধুনিক হিসেবে পরিচিত।
বিশেষ করে—

  • রিয়েল-টাইম ভূমিকম্প পূর্বাভাস প্রযুক্তি
  • শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অফিসে ভূমিকম্প ড্রিল
  • উচ্চ-তলা ভবনে ভূমিকম্প সহনশীল ডিজাইন

এসব ব্যবস্থা প্রাণহানি কমাতে সাহায্য করে।

২০২৫ সালের ভূমিকম্পের এই ঘটনা আরও একবার দেখালো যে প্রস্তুতি থাকলে বড় ধরনের অবস্থাও দ্রুত সামাল দেয়া সম্ভব।

ভবিষ্যৎ ঝুঁকি ও বিশেষজ্ঞদের সতর্কতা

বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন যে জিনজিয়াংসহ মধ্য এশিয়ার ফল্ট লাইনগুলো অত্যন্ত সক্রিয়।
ফলে আগামী দিনগুলোতেও—

  • ৫–৬ মাত্রার মাঝারি ভূমিকম্প
  • ৪ মাত্রার ক্ষুদ্র আফটারশক
  • কিছু ক্ষেত্রে ভূমিধস

এসব ঘটনার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

চীন ইতোমধ্যে পাহাড়ি এলাকায় ভ্রমণকারীদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে।

সর্বশেষ পরিস্থিতি

এই প্রতিবেদনের সময় পর্যন্ত—

  • কোনো প্রাণহানির খবর নেই
  • বড় ধরনের অবকাঠামোগত ক্ষতি পাওয়া যায়নি
  • প্রশাসন সতর্ক রয়েছে
  • বিশেষজ্ঞদের পর্যবেক্ষণ অব্যাহত

আকচি কাউন্টির পরিবহন, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্যসেবা, টেলিযোগাযোগ স্বাভাবিকভাবে কাজ করছে।

চীনের জিনজিয়াং অঞ্চলে ৬ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্প আবারও স্মরণ করিয়ে দিল—ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকাগুলোতে প্রস্তুতি ও দ্রুত সাড়া ব্যবস্থা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। যদিও প্রাথমিকভাবে বড় ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি, তবুও ভূমিকম্পের এমন ঘটনা মধ্য এশিয়া অঞ্চলের জনগণকে সতর্ক করে দেয়।

চীনের প্রযুক্তিগত প্রস্তুতি, দ্রুত উদ্ধার ব্যবস্থা ও কঠোর ভবন নির্মাণ নীতিমালার কারণে এই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতি অনেকটাই কমে এসেছে। তবুও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বড় ফল্ট লাইনে থাকা জিনজিয়াংয়ের মতো অঞ্চলে ভবিষ্যতেও বড় কম্পনের ঝুঁকি থেকেই যাবে।

MAH – 14128 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button