বেতন স্কেলসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলনরত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা আজ বুধবার ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি শুরু করেছেন। এর ফলে তৃতীয় দিনের মতো দেশের অনেক বিদ্যালয়ে বার্ষিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি। তবে, শিক্ষকদের এই কর্মবিরতি ও পরীক্ষা বর্জনের কর্মসূচিতে দেশের প্রাথমিক শিক্ষায় এক দ্বিধাবিভক্ত চিত্র দেখা দিয়েছে। কোথাও কোথাও শিক্ষকরা স্কুলের ফটক ও শ্রেণিকক্ষে তালা ঝুলিয়ে দিলেও, ঢাকাসহ অনেক বিদ্যালয়ে সময়সূচি অনুযায়ী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনকে ঝুঁকিতে ফেলায় সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।
তৃতীয় দিনের কর্মবিরতি: সারাদেশের চিত্র
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের একাংশ ‘প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদ’-এর ব্যানারে গত ২৭ নভেম্বর থেকে কর্মবিরতি শুরু করেন। গত সোমবার থেকে তাঁরা বার্ষিক পরীক্ষা বর্জন কর্মসূচিও শুরু করেন। বুধবার থেকে এই কর্মসূচি ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ হিসেবে পালিত হচ্ছে।
এই কর্মসূচির কারণে সারাদেশের ৬৫ হাজার ৫৬৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চিত্র ভিন্ন ভিন্ন:
- পরীক্ষা স্থগিত: মেহেরপুর, সুনামগঞ্জসহ দেশের অনেক এলাকায় বিদ্যালয়ের ফটক ও শ্রেণিকক্ষে তালা ঝুলিয়ে দেন আন্দোলনরত শিক্ষকেরা। পরীক্ষা দিতে আসা শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে অভিভাবকের সঙ্গে ফিরে যেতে বাধ্য হয়।
- পরীক্ষা অনুষ্ঠিত: ঢাকাসহ খুলনা সিটি কর্পোরেশন এলাকার মতো অনেক বিদ্যালয়ে সময়সূচি অনুযায়ী পরীক্ষা হয়েছে। কোথাও কোথাও প্রধান শিক্ষকেরা ‘কোনোমতো’ পরীক্ষা চালিয়ে নিচ্ছেন।
এই দ্বিধাবিভক্ত চিত্র প্রমাণ করে, সব শিক্ষক সংগঠন এই কর্মসূচিতে একমত নয় এবং অনেক শিক্ষকই শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নিয়ে কোনো আপস করতে রাজি নন।
মেহেরপুরের চিত্র: তালা ঝুলিয়ে দেওয়ার অভিযোগ
কর্মবিরতির কারণে মেহেরপুরের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে চরম অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। মেহেরপুরের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ফটক ও শ্রেণিকক্ষে তালা ঝুলিয়ে দেন আন্দোলনরত সহকারী শিক্ষকেরা। গাংনী উত্তরপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী আজমাইল হোসেন হতাশা নিয়ে বলে, ‘পরীক্ষা দিতে এসে দেখি কক্ষে তালা ঝুলছে। এখন বাড়ি ফিরে যাচ্ছি।’
গাংনী উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম জয়নুল ইসলাম জানান, বিদ্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেওয়ার বিষয়টি তাঁরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছেন। তিনি নির্দেশনা পেলেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। নওপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হামিদুল ইসলাম বলেন, ‘শিক্ষক নেতারা বলেছেন পরীক্ষা বন্ধ রাখতে। এ কারণে পরীক্ষা হচ্ছে না।’
স্বাভাবিক পরীক্ষা গ্রহণ
আন্দোলনের মুখেও ঢাকার অনেক বিদ্যালয়ে পরীক্ষা স্বাভাবিকভাবে চলছে। নীলক্ষেত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জান্নাতুল নাঈমা বলেন, তাঁদের বিদ্যালয়ে সময়সূচি অনুযায়ী পরীক্ষা হচ্ছে এবং ১০ ডিসেম্বর শেষ হবে। খুলনার মতো অঞ্চলেও বাস্তুহারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় বসেছে।
অন্যদিকে, সিলেটের তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, সহকারী শিক্ষকেরা বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়েছেন, তবে তাঁরা কোনো ‘শাটডাউন’ কর্মসূচি পালন করছেন না। সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা ২ নম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নজমুল হায়দার এবং মধ্যনগর উপজেলার সাউদপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. রফিকুল ইসলাম জানান, সহকারী শিক্ষকেরা কর্মবিরতিতে থাকায় প্রধান শিক্ষকেরা কোনো রকমে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা চালিয়ে নিচ্ছেন, তবে এতে সমস্যা হচ্ছে।
শিক্ষকদের ৩ দফা দাবি ও বেতন বৈষম্য
সহকারী শিক্ষকদের মূল তিন দফা দাবি হলো:
১. বেতন গ্রেড: সহকারী শিক্ষকদের জাতীয় বেতন স্কেল আপাতত ১১তম গ্রেড দেওয়া (বর্তমানে ১৩তম গ্রেডে আছেন, যার শুরুর মূল বেতন ১১ হাজার টাকা)। ২. উচ্চতর গ্রেড: চাকরির ১০ ও ১৬ বছর পূর্তিতে উচ্চতর গ্রেড প্রাপ্তির জটিলতার নিরসন। ৩. পদোন্নতি: সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষক পদে শতভাগ বিভাগীয় পদোন্নতি দেওয়া।
প্রায় পৌনে চার লাখের বেশি সহকারী শিক্ষক এই বেতন বৈষম্য এবং পদোন্নতি সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে অসন্তুষ্ট। সহকারী শিক্ষকদের আরেকটি সংগঠন ‘সহকারী শিক্ষক সংগঠন ঐক্য পরিষদ’ এর আহ্বায়ক মো. আনিসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, আগামীকাল বৃহস্পতিবার থেকে তাঁরাও বিদ্যালয়ে ‘তালাবদ্ধ’ কর্মসূচি শুরু করবেন।
মন্ত্রণালয়ের কঠোর অবস্থান ও শাস্তির হুঁশিয়ারি
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় কঠোর অবস্থান নিয়েছে। মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে কর্মবিরতি ও পরীক্ষা বর্জনের কর্মসূচি প্রত্যাহার করে দ্রুত কাজে যোগদানের নির্দেশ দিয়েছে।
মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শিক্ষকদের দাবিগুলো নিয়ে ইতোমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পত্র দেওয়া হয়েছে এবং বেতন কমিশনের সভাপতির সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। মন্ত্রণালয় হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে, চলমান পরীক্ষা গ্রহণে বাধা সৃষ্টিকারী এবং শৃঙ্খলা-বিরোধী কার্যক্রমে সম্পৃক্ত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে সরকারি চাকরি আইন, আচরণ বিধিমালা ও ফৌজদারি আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এই হুঁশিয়ারি প্রমাণ করে, শিক্ষকদের দাবি পূরণের প্রক্রিয়া শুরু হলেও পরীক্ষা বন্ধের মতো কর্মসূচিতে সরকার কোনো ছাড় দেবে না। জানা গেছে, ইতিমধ্যে কয়েকজন শিক্ষককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষার ক্ষতি ও সমাধান জরুরি
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোথাও তালা, কোথাও পরীক্ষা—এই চিত্র দেশের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থায় এক গভীর সঙ্কটকে তুলে ধরে। শিক্ষকদের ন্যায্য দাবি থাকা সত্ত্বেও বার্ষিক পরীক্ষা বন্ধের মতো কর্মসূচি শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনকে মারাত্মক ক্ষতির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর ব্যবস্থা ও শাস্তির হুঁশিয়ারি এলেও, এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন। সরকারকে দ্রুত শিক্ষকদের দাবিগুলো পূরণে সময়সীমা ঘোষণা করতে হবে এবং শিক্ষকদেরও উচিত শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে অবিলম্বে কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে পরীক্ষা গ্রহণ শুরু করা।
এম আর এম – ২৪৯১, Signalbd.com



