দীর্ঘদিনের জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খুলনা-১ আসনে প্রার্থী পরিবর্তনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলটি এই আসনে হিন্দু সম্প্রদায়ের ব্যক্তি কৃষ্ণ নন্দীকে তাদের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছে, যা জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাসে এবারই প্রথম অন্য ধর্মের কোনো ব্যক্তিকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করা হলো। বুধবার (৩ ডিসেম্বর) বিকেলে খুলনা মহানগর জামায়াত কার্যালয়ে জেলার কর্মী সমাবেশে এই চমকপ্রদ ঘোষণা দেন দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সেক্রেটারি জেনারেল ও খুলনা অঞ্চলের পরিচালক মুহাদ্দিস আব্দুল খালেক। এই সিদ্ধান্ত স্থানীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে এবং দেশের রাজনীতিতে জামায়াতের কৌশলগত পরিবর্তন নিয়ে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
কৃষ্ণ নন্দীর প্রার্থিতা ঘোষণা ও আনুষ্ঠানিকতা
খুলনা-১ আসনে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী হিসেবে কৃষ্ণ নন্দীর নাম ঘোষণার মাধ্যমে দলীয়ভাবে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো। দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সেক্রেটারি জেনারেল মুহাদ্দিস আব্দুল খালেক আনুষ্ঠানিকভাবে এই ঘোষণা দেন।
- আসনের বিবরণ: খুলনা-১ আসনটি খুলনার দাকোপ ও বটিয়াঘাটা উপজেলা নিয়ে গঠিত।
- আগের প্রার্থী: খুলনা-১ আসনে এর আগে মো. ইউসুফ নামে একজনকে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছিল জামায়াত।
- প্রার্থিতা নিশ্চিতকরণ: ব্যবসায়ী কৃষ্ণ নন্দী নিজেও তাঁর প্রার্থিতার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
খুলনা জেলা জামায়াত ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুন্সী মঈনুল ইসলাম জানান, ‘খুলনা-১ আসনে জামায়াতের প্রার্থী পরিবর্তন হয়েছে। বাবু কৃষ্ণ নন্দীকে প্রার্থী করা হয়েছে। দলের সিদ্ধান্তে সবাই ঐকমত্যে দাঁড়িপাল্লার হয়ে কাজ করবেন।’
ধর্মীয় পরিচয় ও সাংগঠনিক পদ
কৃষ্ণ নন্দীর এই মনোনয়ন জামায়াতের জন্য একটি বড় কৌশলগত পরিবর্তন। তিনি সনাতন ধর্মের অনুসারী এবং খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগর এলাকার বাসিন্দা। সবচেয়ে চমকপ্রদ তথ্য হলো, তিনি ডুমুরিয়া উপজেলা জামায়াতের হিন্দু সংগঠন ‘জামায়াত ইসলাম সনাতনী’ শাখার সভাপতি।
এই তথ্যের মাধ্যমে বোঝা যায়, জামায়াত ইসলামী দলীয়ভাবে অন্য ধর্মের মানুষদের নিয়ে গঠিত আলাদা সাংগঠনিক শাখা পরিচালনার মাধ্যমে দীর্ঘ সময় ধরে সমাজের এই অংশে কাজ করে আসছে। কৃষ্ণ নন্দীর এই সাংগঠনিক পদ এবং ধর্মীয় পরিচয় থাকা সত্ত্বেও দলীয় প্রার্থী হিসেবে তাঁর নির্বাচন দেশের রাজনীতিতে জামায়াতের অন্তর্ভুক্তিমূলক কৌশলকে সামনে এনেছে।
আমিরের সঙ্গে বৈঠক ও ঐকমত্য
কৃষ্ণ নন্দী জানান, গত ১ ডিসেম্বর জামায়াত ইসলামীর আমির ড. শফিকুর রহমান খুলনায় এলে তিনি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পরে জামায়াত আমির তাঁকে নিয়ে এবং এই আসনে আগে নাম ঘোষণা করা মাওলানা ইউসুফকে নিয়ে একত্রে বৈঠকে বসেন।
কৃষ্ণ নন্দী বলেন, ‘সেখানে আমাকে প্রার্থী হিসেবে কাজ করতে বলা হয়। মাওলানা ইউসুফও আমার সঙ্গে কাজ করার বিষয়ে সম্মতি জানান।’ এই বৈঠক এবং মাওলানা ইউসুফের সম্মতি প্রমাণ করে যে, এই প্রার্থী পরিবর্তনটি দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল নয়, বরং ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি কৌশলগত সিদ্ধান্ত। এই ঐকমত্য খুলনা-১ আসনে দলের জন্য একটি মজবুত ভিত্তি তৈরি করতে সহায়ক হবে।
কৃষ্ণ নন্দীর সক্রিয়তা ও জনসমর্থন
কৃষ্ণ নন্দী রাজনৈতিক অঙ্গনে একজন নতুন মুখ নন। তিনি খুলনা-৫ আসনে জামায়াতের প্রার্থী দলের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারের সঙ্গে গত প্রায় এক বছর ধরে বিভিন্ন সমাবেশে সক্রিয়ভাবে উপস্থিত ছিলেন। খুলনা-৫ আসনটি ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলা নিয়ে গঠিত।
স্থানীয় সূত্র জানায়, কৃষ্ণ নন্দীর নেতৃত্বে খুলনা-৫ আসনে হিন্দু নারী-পুরুষের অংশগ্রহণও ছিল চোখে পড়ার মতো। তাঁর এই সক্রিয়তা এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে তাঁর প্রভাব খুলনা-১ আসনে তাঁকে প্রার্থী করার অন্যতম কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। এই আসনের হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় তাঁর প্রার্থিতা জামায়াতের জন্য ভোটের ক্ষেত্রে একটি বাড়তি সুবিধা দিতে পারে।
বিশ্লেষকদের দৃষ্টিকোণ: জামায়াতের কৌশলগত পরিবর্তন
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাসে অন্য ধর্মের কাউকে প্রার্থী করার এই সিদ্ধান্তটি দলটির কৌশলগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে জামায়াত মূলত দুটি উদ্দেশ্য সাধন করতে চাইছে:
১. উদার ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভাবমূর্তি: এই মনোনয়ন আন্তর্জাতিক মহলে এবং দেশের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবাপন্ন সমাজের কাছে জামায়াতের একটি উদার ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভাবমূর্তি তুলে ধরবে। ২. সংখ্যালঘু ভোট ব্যাংক: খুলনা-১ আসনটি যেখানে হিন্দু অধ্যুষিত, সেখানে স্থানীয় সম্প্রদায়ের কাউকে প্রার্থী করে সংখ্যালঘু ভোট ব্যাংককে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
এই কৌশলটি জামায়াতকে অতীতের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অভিযোগ থেকে বেরিয়ে আসতে এবং দেশের রাজনীতিতে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে সহায়তা করতে পারে।
নতুন দিগন্তে জামায়াতের রাজনীতি
খুলনা-১ আসনে সনাতন ধর্মের কৃষ্ণ নন্দীকে প্রার্থী করার জামায়াতে ইসলামীর এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এটি কেবল জামায়াতের দলীয় ইতিহাসে প্রথম নয়, বরং দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রেও একটি গুরুত্বপূর্ণ নজির। এই চমকপ্রদ কৌশল জামায়াতকে কতটা সফলতা এনে দেয় এবং দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, তা ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেই স্পষ্ট হবে।
এম আর এম – ২৪৯০, Signalbd.com



