ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষা বন্ধ করার শিক্ষকদের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে এক অভিনব প্রতিবাদ দেখিয়েছেন স্থানীয় জনগণ। মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে অভিভাবক ও স্থানীয়রা মিলে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নিয়েছেন। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির নামে বিদ্যালয়ে তালা মারতে গেলে স্থানীয় জনগণ এই উদ্যোগ নেন। বুধবার সকালে উপজেলার ৩৯ নং বড়জোড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এই ঘটনা ঘটে। স্থানীয়দের তোপের মুখে আন্দোলনকারী দুই শিক্ষক স্কুল ছেড়ে যেতে বাধ্য হন। এই ঘটনায় প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে এবং এটি প্রমাণ করে যে, শিক্ষার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অচলাবস্থা জনগণ মেনে নিতে প্রস্তুত নয়।
বিদ্যালয়ে তালা দেওয়ার প্রচেষ্টা ও জনরোষ
দাবি বাস্তবায়ন পরিষদের কর্মসূচির অংশ হিসেবে বুধবার সকালে ৩৯ নং বড়জোড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষা বন্ধ করতে আসেন আন্দোলনকারী সহকারী শিক্ষকরা। স্থানীয় সূত্র ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, প্রধান শিক্ষক শিল্পী ভট্টাচার্য স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা নিতে গেলে সহকারী শিক্ষক মোখলেছুর রহমান ও সাইদুল ইসলাম বিদ্যালয়ে তালা দেওয়ার চেষ্টা করেন।
শিক্ষকদের এই পদক্ষেপের কথা জানতে পেরে স্থানীয় জনগণ ও অভিভাবকরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। স্থানীয়রা দ্রুত ঘটনাস্থলে জড়ো হন এবং তালা মারতে আসা আন্দোলনকারী শিক্ষকদের বিরুদ্ধে তীব্র তোপ শুরু করেন। জনরোষের মুখে ওই দুই সহকারী শিক্ষক বিদ্যালয় ছেড়ে যেতে বাধ্য হন। শিক্ষাবিদরা মনে করেন, এই ঘটনা শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর আন্দোলনকারীদের চাপ সৃষ্টির চেষ্টার বিরুদ্ধে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের বহিঃপ্রকাশ।
মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে পরীক্ষা
আন্দোলনকারী শিক্ষকদের প্রতিরোধের পর স্থানীয়রা নিজেরাই পরীক্ষা গ্রহণের উদ্যোগ নেন। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে দ্রুত মসজিদের মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয় যে, স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। মসজিদের মাইকের ঘোষণা শুনে অভিভাবকরা দ্রুত তাঁদের সন্তানদের নিয়ে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হন।
প্রধান শিক্ষক শিল্পী রাণী ভট্টাচার্য জানান, পরে ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ও স্থানীয় অভিভাবকদের সহযোগিতায় তালা ভেঙে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নেওয়া হয়। এই জনউদ্যোগের ফলে স্কুলের মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৩ জন ছাড়া বাকি সব শিক্ষার্থীই পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। এতে স্পষ্ট হয়, শিক্ষার্থীরা এবং অভিভাবকরা পরীক্ষা বন্ধ রাখার এই আন্দোলনকে সমর্থন করছেন না।
স্থানীয়দের সহযোগিতা ও পরীক্ষার হলে অভিভাবক
বিদ্যালয়ে স্বাভাবিক শিক্ষক অনুপস্থিত থাকায় স্থানীয় লোকজন, অভিভাবক এবং স্কুলের সাবেক শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার হলে দায়িত্ব পালন করেন। সরেজমিনে দেখা যায়, পরীক্ষার হলে দায়িত্ব পালন করছেন অভিভাবক ও সাবেক শিক্ষার্থীরা। তাঁরা শিক্ষার্থীদের তদারকি করেন এবং সুষ্ঠু পরিবেশে পরীক্ষা সম্পন্ন করতে সহায়তা করেন।
পরীক্ষা শেষে শিক্ষার্থীরা উত্তরপত্র জমা দিয়ে বিদ্যালয় ত্যাগ করে। অভিভাবক ও স্থানীয়দের এই সহযোগিতা প্রমাণ করে, তাঁরা তাদের সন্তানদের শিক্ষাজীবনকে ঝুঁকিতে ফেলতে চান না। এই ধরনের জনউদ্যোগ প্রাথমিক শিক্ষা খাতে শিক্ষকদের কর্মবিরতির কারণে সৃষ্ট সমস্যা মোকাবিলায় একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
ইউএনও’র অবস্থান ও শিক্ষাবিভাগের প্রতিক্রিয়া
ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সানজিদা রহমান তার সরকারি ফেসবুক পেজ থেকে আগেই পরীক্ষা হবে—এই বিষয়টি নিশ্চিত করে একটি পোস্ট দিয়েছিলেন। ইউএনও’র এই আগাম বার্তাটি অভিভাবকদের আশ্বস্ত করেছিল এবং তাঁদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে উৎসাহিত করেছিল।
এ বিষয়ে ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা শিক্ষা অফিসার সৈয়দ আহমেদ জানান, ‘বিষয়টি জানতে পেরেছি। আশা করছি অচিরেই এ সমস্যার সমাধান হবে।’ শিক্ষা কর্মকর্তার এই মন্তব্য সরকারের পক্ষ থেকে সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ নেওয়ার ইঙ্গিত দেয়। অন্যদিকে, আন্দোলনকারী সহকারী শিক্ষক মোখলেছুর রহমান ও সাইদুল ইসলাম বিদ্যালয়ে তালা দেওয়ার কথা অস্বীকার করে জানান, এটি অপপ্রচার এবং নিরাপত্তার কারণে তাঁরা বিদ্যালয় ত্যাগ করেছিলেন।
কর্মবিরতির পূর্বপটভূমি ও সরকারের কঠোরতা
শিক্ষকদের এই আন্দোলন চলছে তাঁদের ১১তম গ্রেডে বেতন, উচ্চতর গ্রেড জটিলতা নিরসন ও শতভাগ বিভাগীয় পদোন্নতিসহ তিন দফা দাবিতে। প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদ গত সোমবার থেকে পরীক্ষা বর্জন কর্মসূচি শুরু করে এবং বুধবার থেকে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি শুরু করে।
এই আন্দোলনের বিপরীতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় কঠোর অবস্থান নিয়েছে। মন্ত্রণালয় হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে, আন্দোলনরত শিক্ষকরা কাজে যোগ না দিলে তাদের বিরুদ্ধে সরকারি চাকরি আইন ও ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকারের এই কঠোর অবস্থানের মুখে স্থানীয় জনগণের পরীক্ষা গ্রহণের এই উদ্যোগ শিক্ষকদের ওপর চাপ বাড়াবে।
শিক্ষার অধিকার রক্ষায় জনউদ্যোগ
ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের এই ঘটনা দেশের প্রাথমিক শিক্ষার ইতিহাসে এক স্মরণীয় জনউদ্যোগ। শিক্ষকদের ন্যায্য দাবি থাকলেও কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা বন্ধ করার মতো অনৈতিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগণের এই প্রতিবাদ ছিল শিক্ষার অধিকার রক্ষার প্রতীক। মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে এবং তালা ভেঙে পরীক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে স্থানীয়রা প্রমাণ করলেন যে, শিক্ষার মতো মৌলিক বিষয়ে কোনো আপস তারা মানবেন না। এই জনউদ্যোগ একদিকে যেমন শিক্ষকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে, অন্যদিকে তেমনি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরকে দ্রুত এই অচলাবস্থা নিরসনে বাধ্য করবে।
এম আর এম – ২৪৮৭, Signalbd.com



