শিক্ষা

নতুন করে ১১৭২ জাল সনদধারী শিক্ষক শনাক্ত: বেতন-ভাতাসহ ২৫৩ কোটি টাকা ফেরতের সুপারিশ

Advertisement

দেশের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নতুন করে আরও এক হাজার ১৭২ জন জাল সনদধারী শিক্ষক ও কর্মচারী শনাক্ত করেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ)। জাল সনদে চাকরি করে তাঁরা বেতন-ভাতা হিসেবে নেওয়া বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। এই জালিয়াতির ঘটনায় ডিআইএ মোট ২৫৩ কোটি টাকা ফেরতের সুপারিশ করেছে। এছাড়াও, ভুয়া নিয়োগ, অর্থ আত্মসাৎ এবং ভ্যাট ও আইটিসহ বিভিন্ন ধরনের আর্থিক অনিয়মের কারণে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ারও সুপারিশ করা হবে। ডিআইএ পরিচালক অধ্যাপক এম এম সহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, জাল সনদধারীদের একটি তালিকা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে এবং তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় কঠোর ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হবে।

জাল সনদ শনাক্তের পরিসংখ্যান ও আর্থিক অনিয়ম

পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ) দেশের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগের নথি যাচাই-বাছাই করে নতুন করে এই বিপুল সংখ্যক জাল সনদধারী শনাক্ত করেছে। ডিআইএর নথির তথ্য অনুযায়ী:

  • মোট শনাক্ত: নতুন করে ১ হাজার ১৭২ জন জাল সনদধারী শিক্ষক-কর্মচারী শনাক্ত হয়েছেন।
  • সম্পূর্ণ ভুয়া সনদ: এই ১ হাজার ১৭২ জনের মধ্যে ৪০০ জনের সনদ সম্পূর্ণ ভুয়া বা অস্তিত্বহীন।
  • অগ্রহণযোগ্য সনদ: প্রায় ৩০০ জনের সনদ অগ্রহণযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

জাল সনদে চাকরি করা এই শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা হিসেবে নেওয়া অর্থসহ ভুয়া নিয়োগ, অর্থ আত্মসাৎ এবং ভ্যাট ও আইটি সংক্রান্ত বিভিন্ন আর্থিক অনিয়মের কারণে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে মোট ২৫৩ কোটি টাকা ফেরতের সুপারিশ করা হয়েছে। এই বিপুল পরিমাণ আর্থিক অনিয়ম দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় দুর্নীতির ভয়াবহতা তুলে ধরে।

বিভাগভিত্তিক জাল সনদধারীর চিত্র

ডিআইএর নথির তথ্যানুযায়ী, দেশের বিভিন্ন বিভাগে জাল সনদধারী শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যায় ব্যাপক তারতম্য দেখা গেছে। এই তালিকায় রাজশাহী বিভাগ শীর্ষে রয়েছে।

বিভাগশনাক্ত জাল সনদধারীর সংখ্যা
রাজশাহী বিভাগ৭৭৯ জন (সর্বাধিক)
খুলনা বিভাগ১৭৯ জন
মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর১২০ জন
ঢাকা বিভাগ৭০ জন
চট্টগ্রাম বিভাগ২৪ জন

রাজশাহী বিভাগে একাই ৭৭৯ জন জাল সনদধারী শিক্ষক-কর্মচারী শনাক্ত হওয়ায় শিক্ষা প্রশাসনের শিথিলতা এবং জালিয়াতির মাত্রা স্পষ্ট হয়েছে। অন্যদিকে মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনেও ১২০ জন জাল সনদধারী শনাক্ত হওয়া উদ্বেগজনক।

ডিআইএর পদক্ষেপ ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশ

পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ) এই জালিয়াতির ঘটনায় কঠোর ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত। ডিআইএ পরিচালক অধ্যাপক এম এম সহিদুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, জাল সনদধারীদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে।

তিনি জানান, ‘তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করা হবে।’ ডিআইএ প্রতিবেদনে জাল সনদধারীদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্টভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করছে। এর মধ্যে রয়েছে:

১. চাকরি থেকে বরখাস্ত: অবিলম্বে জাল সনদধারী শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা।

২. অর্থ ফেরত: তাদের বেতন-ভাতা হিসেবে নেওয়া ২৫৩ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত আনার প্রক্রিয়া শুরু করা।

৩. আইনি ব্যবস্থা: জালিয়াতি এবং অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়েরের সুপারিশ করা।

প্রথম ধাপে ডিআইএ ৪০০ জাল সনদধারী শিক্ষকের একটি তালিকা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠাবে বলে জানা গেছে।

জাল সনদের পূর্বপটভূমি ও শিক্ষার মান নিয়ে উদ্বেগ

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাল সনদে চাকরির ঘটনা নতুন নয়। অতীতেও ডিআইএ বিভিন্ন সময়ে জাল সনদধারী শিক্ষকদের শনাক্ত করেছে। এই ধরনের জালিয়াতিগুলো মূলত একটি সুসংগঠিত চক্রের মাধ্যমে ঘটে থাকে, যারা অর্থের বিনিময়ে ভুয়া সনদ সরবরাহ করে।

জাল সনদধারী শিক্ষকদের নিয়োগের ফলে দেশের শিক্ষার মান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অযোগ্য শিক্ষক বা কর্মচারীরা বছরের পর বছর ধরে রাষ্ট্রের অর্থ গ্রহণ করে আসছেন, যা দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষার ভিত্তি দুর্বল করে দিচ্ছে। শিক্ষাবিদরা মনে করেন, এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি এবং স্থানীয় প্রভাবশালী চক্রকে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

জালিয়াতির চক্র ও আর্থিক অনিয়ম

জাল সনদের এই বিপুল সংখ্যক নিয়োগের পেছনে কেবল শিক্ষকরাই নন, বরং এক বিশাল আর্থিক লেনদেনের চক্র কাজ করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ভুয়া নিয়োগের প্রক্রিয়ায় ঘুষ, অর্থ আত্মসাৎ এবং অন্যান্য আর্থিক অনিয়ম জড়িত রয়েছে। প্রতিবেদনে ভ্যাট ও আইটিসহ বিভিন্ন ধরনের আর্থিক অনিয়মের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যা দুর্নীতি ও জালিয়াতির এই নেটওয়ার্কের বিস্তৃতি প্রমাণ করে।

সরকারের উচিত, শুধু শিক্ষকদের শাস্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থেকে, সনদ জালিয়াত চক্রের মূল হোতাদের এবং তাদের মদদদাতাদের খুঁজে বের করে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা। এই আর্থিক অনিয়মের তদন্ত সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অঙ্গীকারের একটি বড় পরীক্ষা।

শিক্ষার শুদ্ধি অভিযান ও জবাবদিহিতা

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুন করে ১ হাজার ১৭২ জন জাল সনদধারী শিক্ষক শনাক্ত এবং ২৫৩ কোটি টাকা ফেরতের সুপারিশ দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় একটি শুদ্ধি অভিযানের ইঙ্গিত দেয়। এই পদক্ষেপ শিক্ষা খাতের দুর্নীতি এবং অনিয়মের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর অবস্থানকে তুলে ধরে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে দ্রুত এই তালিকা অনুযায়ী অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে জালিয়াতদের আর কেউ যেন এই ধরনের অপরাধ করার সাহস না পায়। শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে এবং রাষ্ট্রের অর্থের অপচয় রোধ করতে জাল সনদধারীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি অপরিহার্য।

এম আর এম – ২৪৮৬, Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button