আঞ্চলিক

৮ কুকুরছানাকে হত্যা: অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে সরকারি বাসা ছাড়ার নির্দেশ

Advertisement

পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলায় পুকুরের পানিতে ডুবিয়ে আটটি কুকুরছানাকে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে উপজেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তাকে সরকারি বাসভবন ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। উপজেলা কৃষক উন্নয়ন ফাউন্ডেশনে কর্মরত অভিযুক্ত কর্মকর্তা হাসানুল রহমানকে আজ মঙ্গলবার সকালে উপজেলা প্রশাসন এই শাস্তি প্রদান করে। এই অমানবিক ও নিষ্ঠুর ঘটনায় এলাকায় তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। ঘটনার পর থেকেই কুকুরছানাগুলোর মা কুকুরটিকে উপজেলা পরিষদ এলাকায় আর্তনাদ করতে দেখা গেছে, যা দেখে স্থানীয়দের চোখও ভিজে ওঠে। প্রশাসন এবং প্রাণিসম্পদ বিভাগ এই ঘটনার আইনগত প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

পুকুর থেকে উদ্ধার ও ঘটনার বিবরণ

এই অমানবিক ঘটনাটি ঘটে ঈশ্বরদী উপজেলা পরিষদের আবাসিক এলাকায়। গতকাল সোমবার সকালে উপজেলা পরিষদের একটি পুকুর থেকে বস্তাবন্দী অবস্থায় আটটি কুকুরছানার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।

স্থানীয় লোকজন ও উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, প্রায় এক সপ্তাহ আগে অভিযুক্ত কর্মকর্তা হাসানুল রহমানের সরকারি বাসভবনের আঙিনায় মা কুকুরটি আটটি ছানার জন্ম দেয়। ছানাগুলোর জন্ম দেওয়ার পর থেকেই তারা ওই এলাকায় ছিল। ঘটনার পরদিন অর্থাৎ সোমবার সকাল থেকেই মা কুকুরটিকে পুকুরের পাশে ছোটাছুটি করতে এবং আর্তনাদ করতে দেখা যায়। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পুকুরটিতে একটি বস্তা ভাসতে দেখা গেলে স্থানীয়দের সন্দেহ হয়। বস্তাটি তুলে ভেতরে মৃত অবস্থায় আটটি কুকুরছানা পাওয়া যায়, যা নিশ্চিত করে যে কুকুরছানাগুলোকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে।

অভিযুক্ত কর্মকর্তা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা

আটটি কুকুরছানাকে হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত কর্মকর্তা হলেন হাসানুল রহমান, যিনি উপজেলা কৃষক উন্নয়ন ফাউন্ডেশনে কর্মরত। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মনিরুজ্জামান এই ঘটনায় চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

ইউএনও মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘ছানাগুলোকে এভাবে হত্যা করা চরম অমানবিক ও নিষ্ঠুর কাজ। শাস্তিস্বরূপ অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে এক দিনের মধ্যে সরকারি কোয়ার্টার ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ অভিযুক্ত কর্মকর্তা হাসানুল রহমান এই ঘটনায় লজ্জিত ও দুঃখিত বলে প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘সন্তানদের নিরাপত্তার কথা ভেবে আমার স্ত্রী ছানাগুলোকে সরিয়ে দিতে বলেছিল। কিন্তু এগুলো যে মারা যাবে, তা ভাবিনি।’ যদিও তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন, তবুও তাঁর বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

মা কুকুরটির আর্তনাদ ও মানুষের সহানুভূতি

এই ঘটনার পর থেকে কুকুরছানাগুলোর মা কুকুরটির করুণ দৃশ্য স্থানীয়দের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। আজও সকাল থেকে মা কুকুরটিকে উপজেলা পরিষদের দ্বিতীয় তলায় ইউএনওর কক্ষের সামনে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেছে। সে বারবার ছানাগুলোর জন্য আর্তনাদ করছিল। কয়েকজন কর্মচারী কুকুরটিকে সেখান থেকে তাড়ানোর চেষ্টা করেও সফল হননি।

পরে দুপুর ১২টার দিকে কয়েকজন কর্মচারী কুকুরটিকে আদর করে নিচে নামান। তবে বিকেল পর্যন্ত কুকুরটিকে উপজেলা পরিষদের আশপাশে ঘুরঘুর করতে দেখা গেছে। মা কুকুরটির এই নীরব প্রতিবাদ এবং আর্তনাদ ঘটনাস্থলে উপস্থিত সকলের চোখে জল এনেছে। সাবেক ইউএনও সুবীর কুমার দাশও তাঁর ফেসবুক পোস্টে এই ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেন এবং জড়িতদের বিচার দাবি করেন।

আইনগত দিক ও বিচারের দাবি

এই ধরনের প্রাণী হত্যা আইন অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আকলিমা খাতুন মন্তব্য করেছেন যে, কুকুরছানাগুলোকে হত্যা করা আইন অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তিনি বলেন, ‘আমরা বিষয়টি পুলিশকে জানিয়েছি। আইনগত প্রক্রিয়া চলছে।’

প্রকৃতি ও বন্য প্রাণীবিষয়ক স্থানীয় সংগঠন ‘নেচার অ্যান্ড ওয়াইল্ড লাইফ কনসার্ভসন কমিউনিটির সভাপতি এহসান আলী বিশ্বাস বলেন, ‘জীবজন্তুদের রক্ষায় দেশে আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ নেই। মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হলে, এই ন্যক্কারজনক ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা প্রয়োজন।’ ঈশ্বরদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আ স ম আবদুর নূর বলেন, ‘বিষয়টি আমরা তদন্ত করছি। উপজেলা প্রশাসন ও প্রাণিসম্পদ বিভাগের সঙ্গে কথা বলেছি। আইনগত বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে।’

সাবেক ইউএনও’র ক্ষোভ ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া

ঈশ্বরদীর সাবেক ইউএনও সুবীর কুমার দাশ এই ঘটনায় গভীরভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তিনি গতকাল দুপুরে ফেসবুকে এক পোস্টে লিখেন, ‘আমার সাবেক কর্মস্থলে কয়েকটি পোষা কুকুর ছিল, যার একটির নাম লাল্টু। ওর জন্ম থেকে আমি লালনপালন করেছি। আমার বদলির পর সেখানে কুকুরছানাদের ওপর অন্ধকার নেমে আসে।’ তিনি এই ঘটনায় জড়িত সরকারি কর্মকর্তা ও তাঁর পরিবারের কঠোর বিচারের দাবি জানিয়েছেন।

সাধারণ মানুষ এবং পশুপ্রেমী সংগঠনগুলো এই ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। তারা মনে করেন, ক্ষমতার অপব্যবহার করে এমন অমানবিক কাজ করা শুধু নিষ্ঠুরতাই নয়, এটি সামাজিক অবক্ষয়েরও লক্ষণ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে কঠোর শাস্তির দাবি উঠেছে।

অমানবিকতার বিচার ও সচেতনতা

ঈশ্বরদীতে আটটি কুকুরছানাকে পুকুরে ডুবিয়ে হত্যার ঘটনাটি এক চরম অমানবিক ও নিষ্ঠুর কাজ। অভিযুক্ত কর্মকর্তা হাসানুল রহমানকে সরকারি বাসা ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হলেও, পশুপ্রেমী এবং স্থানীয় জনগণ এই ঘটনার আইনগত বিচার দাবি করছেন। মা কুকুরটির আর্তনাদ এই ঘটনার হৃদয় বিদারক দিকটি তুলে ধরেছে। আইন অনুযায়ী এই অপরাধে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং জনগণের মধ্যে প্রাণী সুরক্ষার বিষয়ে আরও ব্যাপক সচেতনতা তৈরি করাই এখন জরুরি।

এম আর এম – ২৪৬৮, Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button