বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশ পাঠাতে চাইলে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। মঙ্গলবার (২ ডিসেম্বর) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এই তথ্য নিশ্চিত করেন। তৌহিদ হোসেন বলেন, খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেওয়ার বিষয়ে সরকার প্রস্তুত রয়েছে। চিকিৎসকদের সিদ্ধান্ত এবং দলের মতামতের ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। এই আশ্বাসটি সরকারের পক্ষ থেকে দেশের প্রধান বিরোধী নেতার প্রতি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং চিকিৎসা সহায়তার অঙ্গীকারকে তুলে ধরে।
সরকারের প্রস্তুতি: চিকিৎসকদের মতামতের ওপর নির্ভরতা
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের বক্তব্য অনুযায়ী, বেগম খালেদা জিয়াকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য পাঠানোর বিষয়ে সরকার সর্বাত্মকভাবে প্রস্তুত। তিনি স্পষ্ট করে দেন যে, এই বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রশাসনিক বাধার সৃষ্টি হবে না। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি নির্ভর করছে দুটি বিষয়ের ওপর:
১. চিকিৎসকদের সিদ্ধান্ত: খালেদা জিয়ার চিকিৎসায় নিয়োজিত দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ড যদি মনে করে যে, তাঁর বর্তমান শারীরিক জটিলতাগুলোর জন্য দেশের বাইরে চিকিৎসা প্রয়োজন। ২. দলের মতামত: বিএনপি বা তাঁর পরিবার যদি তাঁকে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে সিদ্ধান্ত নেয়।
তৌহিদ হোসেনের এই মন্তব্য প্রমাণ করে, সরকার মানবিক দিকটিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে এবং আইনি প্রক্রিয়া সহজ করার জন্য প্রস্তুত।
খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য ও ডা. জাহিদের আশ্বাস
বর্তমানে ৮০ বছর বয়সী বেগম খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে হৃদ্রোগ, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস, লিভার সিরোসিস ও কিডনি জটিলতাসহ নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন। গত ২৩ নভেম্বর শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে দ্রুত তাঁকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
মঙ্গলবার দুপুরে খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়ে এক ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘দেশনেত্রীর স্বাস্থ্য নিয়ে গুজব না ছড়ানোর জন্য সবাইকে অনুরোধ করছি। আপনারা ধৈর্য ধরুন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আল্লাহর রহমতে এবং সবার সহযোগিতা ও দোয়ার কারণে হয়তো এবার আমরা তাকে আমাদের মাঝে ফিরে পাবো।’ বিদেশে চিকিৎসার বিষয়ে ডা. জাহিদ বলেন, ‘এ জন্য আমাদের সব প্রস্তুতি আছে। মেডিকেল বোর্ড পরামর্শ দিলেই আমরা তাকে বিদেশে নিয়ে যাব।’ এই মন্তব্যগুলো সরকারের প্রস্তুতির সঙ্গে দলীয় প্রস্তুতির সমন্বয়কে নির্দেশ করে।
তারেক রহমানের ট্রাভেল পাস প্রসঙ্গ
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন একইসঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়েও সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দেন। তিনি বলেন, তারেক রহমান দেশে ফেরার জন্য এখনও ‘ট্রাভেল পাস’ আবেদন করেননি।
তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘উনি চাইলেই ইস্যু হবে। তবে আমার জানামতে এখনও তিনি চাননি।’ তিনি মনে করেন, তারেক রহমান তাঁর পাসপোর্ট মেয়াদোত্তীর্ণ বা অনুপস্থিত থাকলে এক দিনের মধ্যে ওয়ান-টাইম ট্রাভেল পাস নিয়ে সহজেই দেশে ফিরতে পারেন। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা আরও বলেন, তারেক রহমানের দেশে ফেরার বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে কোনো সুনির্দিষ্ট আনুষ্ঠানিক তথ্য নেই। এই মন্তব্য প্রমাণ করে যে, তারেক রহমানের দেশে ফেরা এখন সম্পূর্ণরূপে তাঁর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত এবং রাজনৈতিক কৌশলগত সময়ের ওপর নির্ভরশীল।
সরকারের ধারাবাহিক আশ্বাস
তৌহিদ হোসেনের এই আশ্বাস প্রথম নয়। এর আগে গত ৩০ নভেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবে তিনি বলেছিলেন, তারেক রহমান দেশে আসতে চাইলে কোনো বাধা নেই এবং একদিনের মধ্যে ট্রাভেল পাস ইস্যু করা সম্ভব। একইসঙ্গে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলও তারেক রহমানের দেশে ফেরার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সহযোগিতা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতের আশ্বাস দিয়েছিলেন।
সরকারের এই দুই গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টার পক্ষ থেকে বারবার একই ধরনের ইতিবাচক বার্তা আসায় রাজনৈতিক মহল মনে করছে, তারেক রহমানের দেশে ফেরা এবং খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার ক্ষেত্রে সরকারের দিক থেকে এখন কোনো আনুষ্ঠানিক বাধা নেই। এই পরিবর্তনটি সরকারের মানবিক ও সহনশীল মনোভাবের ইঙ্গিত দেয়।
বিদেশে চিকিৎসার আইনি ও মানবিক দিক
বেগম খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসা প্রয়োজন হলে সরকার ব্যবস্থা নেবে—এই আশ্বাসটি মানবিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং জ্যেষ্ঠ নাগরিক হিসেবে তাঁর উন্নত চিকিৎসার অধিকার রয়েছে। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে তাঁর পরিবার দীর্ঘদিন ধরেই তাঁকে বিদেশে নিতে চেয়েছিল।
যদিও তাঁর বিদেশে চিকিৎসার আইনি জটিলতা বিদ্যমান, সরকারের এই বক্তব্য ইঙ্গিত দেয় যে, মানবিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর দল বা পরিবারের সিদ্ধান্তের প্রতি সরকার সম্মান জানাবে এবং প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক সহযোগিতা দেবে। এই পদক্ষেপটি দেশের রাজনীতিতে উত্তেজনা কমিয়ে সহনশীলতা ও আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে সহায়ক হতে পারে।
মানবিকতা ও রাজনীতির পরীক্ষা
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের এই ঘোষণা বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমান—উভয়ের ক্ষেত্রেই সরকারের অবস্থানকে স্পষ্ট করেছে। খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার জন্য সরকার প্রস্তুত, তবে সিদ্ধান্ত মেডিকেল বোর্ড ও দলের হাতে। অন্যদিকে, তারেক রহমানের দেশে ফেরা নির্ভর করছে তাঁর ট্রাভেল পাসের আবেদনের ওপর। সরকারের এই ‘গ্রিন সিগন্যাল’ দেশের রাজনীতির জন্য এক বড় পরীক্ষা। এখন দেখার বিষয়, বিএনপি এবং জিয়া পরিবার তাদের নেত্রীর জীবন বাঁচাতে এবং দলের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে কী ধরনের কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেয়।
এম আর এম – ২৪৬২, Signalbd.com



