জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করার দায়ে নরসিংদীর পলাশ উপজেলার যুবলীগ নেতা দেলোয়ার হোসেন দেলুর সাড়ে ৮ কোটি টাকার সম্পত্তি ক্রোক (জব্দ) করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সোমবার (০১ ডিসেম্বর) দুপুরে সমন্বিত জেলা গাজীপুর ও নরসিংদী কার্যালয়ের তত্ত্বাবধানে ডাঙ্গা ইউনিয়নে দেলোয়ারের অবৈধ আয়ে অর্জিত দুটি বহুতল ভবনসহ অন্যান্য স্থাবর সম্পদ ক্রোক করে সরকারি তত্ত্বাবধানে দেওয়া হয়। অভিযুক্ত যুবলীগ নেতা দেলোয়ার হোসেন কাজিরচর গ্রামের সুরুজ আলীর ছেলে এবং ডাঙা ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা, রাহাজানি, চাঁদাবাজি ও জমিদখলসহ প্রায় অর্ধশত মামলা রয়েছে। এই অভিযান বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দুর্নীতিবিরোধী কঠোর অবস্থানের অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
দুদকের অভিযান ও জব্দকৃত সম্পদের বিবরণ
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী এই অভিযান পরিচালনা করে। দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় গাজীপুর (নরসিংদী) এর সহকারী পরিচালক মো. এনামুল হক কর্তৃক দায়ের করা আবেদনের ভিত্তিতে আদালত এই আদেশ দেন। আদালতের নির্দেশনার পরই দুদক ও স্থানীয় প্রশাসন দেলোয়ার হোসেন দেলুর অবৈধ সম্পত্তি জব্দের প্রক্রিয়া শুরু করে।
পলাশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু বক্কর সিদ্দিকী নিশ্চিত করেছেন যে, আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী ডাঙ্গা ইউনিয়নে যুবলীগ নেতা দেলোয়ার হোসেন দেলুর দুটি বহুতল ভবন ক্রোক করে সরকারি তত্ত্বাবধানে দেওয়া হয়েছে। জব্দকৃত সম্পদের আনুমানিক মূল্য সাড়ে ৮ কোটি টাকা। অভিযানে দুদকের কর্মকর্তার পাশাপাশি পলাশ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, ডাঙ্গা ইউনিয়ন ভূমি অফিসের উপ-সহকারী কর্মকর্তা শিউলি রানি ধর, এবং জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সদস্য হলধর দাস উপস্থিত ছিলেন। ক্রোককৃত ভবনে সাইনবোর্ড টানানো হয়েছে এবং সেখানে বসবাসরতদের অন্যত্র সরে যাওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
আইনি প্রক্রিয়া: ক্রোকাদেশ ও রিসিভার নিয়োগ
দেলোয়ার হোসেন দেলুর অবৈধ সম্পদের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ২০২৩ সালের ১২ ডিসেম্বর। ওই দিন দুদক সমন্বিত জেলা কার্যালয় (গাজীপুর-নরসিংদী)-এর সহকারী পরিচালক মো. এনামুল হক দুর্নীতি দমন কমিশন বিধিমালা ২০০৭ সংশোধনী ২০১৯ এর ১৮ বিধি অনুযায়ী দেলোয়ারের অবৈধ সম্পদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আদালতে আবেদন করেন।
আদালত এই অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা খুঁজে পাওয়ায়, দেলোয়ার হোসেন দেলুর জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তাঁর স্থাবর সম্পদ ক্রোকাদেশ এবং রিসিভার নিয়োগের আদেশ জারি করেন। রিসিভার নিয়োগের অর্থ হলো, জব্দকৃত সম্পত্তির দেখাশোনা এবং তত্ত্বাবধান এখন আদালতের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এটি দুর্নীতি দমন কমিশনের একটি কঠোর আইনি পদক্ষেপ, যা দুর্নীতিবাজদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করে।
অভিযুক্ত নেতার অতীত ও অপরাধের তালিকা
দেলোয়ার হোসেন দেলু কেবল অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযুক্ত নন, তাঁর বিরুদ্ধে আরও গুরুতর অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় হত্যা, রাহাজানি, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, জমিদখলসহ প্রায় অর্ধশত মামলা রয়েছে। একজন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে এত বিপুল সংখ্যক গুরুতর অপরাধের অভিযোগ থাকা স্থানীয় রাজনীতিতে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং আইন-শৃঙ্খলার দুর্বলতার চিত্র তুলে ধরে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, দেলোয়ার হোসেন দেলু দীর্ঘদিন ধরে তাঁর রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এলাকায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছিলেন। তাঁর এই অপরাধের তালিকা তাঁর অবৈধ সম্পদ অর্জনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত বলে মনে করা হচ্ছে। তাঁর এই ক্ষমতা এবং অর্থের উৎস অনুসন্ধানে আরও অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসতে পারে।
রাজনৈতিক পটভূমি ও আত্মগোপন
দেলোয়ার হোসেন দেলু ডাঙা ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি পদে থাকাকালীন তাঁর অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যান। তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো মূলত আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনামলের শেষ দিকে ক্ষমতার অপব্যবহারের ইঙ্গিত দেয়।
গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকার পতনের পর থেকে যুবলীগ নেতা দেলোয়ার হোসেন দেলু আত্মগোপনে চলে যান। সরকারের পট পরিবর্তনের পর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অনেক বিতর্কিত নেতার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে, যার অংশ হিসেবে দেলোয়ার হোসেন দেলুর বিরুদ্ধেও এই ক্রোকাদেশ জারি হলো। তাঁর আত্মগোপনে যাওয়া প্রমাণ করে, তিনি আইনি ব্যবস্থা থেকে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করছেন।
দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের প্রভাব
দুদকের এই কঠোর অভিযান বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ‘দুর্নীতিমুক্ত সমাজ’ গড়ার প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন। দেলোয়ার হোসেন দেলুর মতো স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে এমন বড় আকারের পদক্ষেপ দুর্নীতি দমনে সরকারের সদিচ্ছাকে তুলে ধরে। এই ধরনের পদক্ষেপ স্থানীয় রাজনীতিতে একটি জবাবদিহিতার সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ক্ষমতার ছত্রছায়ায় যারা অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন এবং আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে এই ধরনের আইনি প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা উচিত। এই অভিযান সাধারণ মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচার এবং আইনের শাসনের প্রতি আস্থা বাড়াতে সাহায্য করবে। একই সাথে এটি দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক নেতাদের জন্য একটি কঠোর সতর্কবার্তা।
বিচার ও জবাবদিহিতার প্রতিষ্ঠা
নরসিংদীর যুবলীগ নেতা দেলোয়ার হোসেন দেলুর সাড়ে ৮ কোটি টাকার সম্পত্তি জব্দ করার ঘটনাটি দেশের দুর্নীতি দমন কার্যক্রমে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। তাঁর বিরুদ্ধে আনা গুরুতর অপরাধ ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগগুলো স্থানীয় রাজনীতিতে মাফিয়াতন্ত্রের প্রভাবকে তুলে ধরে। আদালতের নির্দেশে এই সম্পদ জব্দ হওয়ায়, ন্যায়বিচার এবং জবাবদিহিতার প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠিত হলো। সরকারের উচিত, দেলোয়ার হোসেন দেলুকে দ্রুত গ্রেপ্তার করে তাঁর বিরুদ্ধে আনা হত্যা, চাঁদাবাজি ও অন্যান্য মামলার বিচার প্রক্রিয়াকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, যাতে দুর্নীতি ও অপরাধের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যায়।
এম আর এম – ২৪৪৩,Signalbd.com



