রাজশাহী পর্যটন মোটেলে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) পরিচিতি সভা চলাকালীন দলটির দুই পক্ষের তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। এই উত্তেজনার মধ্যেই নবগঠিত মহানগর কমিটির দুই নেতা সেখানে উপস্থিত সংবাদকর্মীদের ওপর চড়াও হন। তাদের একজন, যার নাম শোয়েব বলে জানা গেছে, সাংবাদিকদের সভাকক্ষ থেকে বেরিয়ে যেতে হুকুম দেন এবং দরজায় তালা মেরে ভেতরে আগুন দেবারও হুমকি দেন। সোমবার (১ ডিসেম্বর) বিকেল সাড়ে চারটার দিকে এই ঘটনা ঘটে। এনসিপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল যখন চরম আকার ধারণ করে, তখন সাংবাদিকদের ওপর হামলার চেষ্টা করায় কর্মরত সংবাদকর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এবং জড়িতদের বিচার দাবি করেছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ঘটনাস্থলে পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
সংঘর্ষের সূত্রপাত: মহানগর কমিটির বাধা
এনসিপি’র নবগঠিত রাজশাহী জেলা আহ্বায়ক কমিটি তাদের পরিচিতি সভা উপলক্ষে রাজশাহী পর্যটন মোটেলে সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে। এই সম্মেলন চলাকালে এনসিপি মহানগর কমিটির একাংশ প্রায় ত্রিশজনের একটি দল সেখানে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তোলে।
এই বিক্ষুব্ধ পক্ষটি জেলা কমিটির আহ্বায়ক সাইফুল আলমকে ‘আওয়ামী লীগের দোসর’ আখ্যা দিয়ে তাঁর কর্মসূচি ভণ্ডুল করার চেষ্টা চালায়। তাদের অভিযোগ ছিল, নবগঠিত জেলা কমিটি সঠিক প্রক্রিয়ায় তৈরি হয়নি এবং এর নেতারা সরকারের সঙ্গে যোগসাজশ করে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছেন। মূলত অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং কমিটির নেতৃত্ব নিয়ে এই বিভেদ থেকেই উত্তেজনার সূত্রপাত।
সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও আগুন দেওয়ার হুমকি
উত্তেজনার এক পর্যায়ে মহানগর কমিটির দুই নেতা সরাসরি সংবাদ সম্মেলন কক্ষে প্রবেশ করেন। তাঁরা সেখানে কর্মরত সংবাদকর্মীদের লক্ষ্য করে আক্রমণাত্মক আচরণ শুরু করেন। তাঁরা সাংবাদিকদের অবিলম্বে সভাকক্ষ ছেড়ে চলে যেতে হুকুম দেন।
ঘটনার তীব্রতা বাড়ে যখন ওই দুই নেতা হুমকি দেন যে, সাংবাদিকরা যদি কক্ষ থেকে বেরিয়ে না যান, তবে তাঁরা দরজায় তালা মেরে ভেতরে আগুন দিয়ে দেবেন। এই চরম হুমকি কর্মরত সাংবাদিকদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করে। সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হওয়া ওই দুই নেতার মধ্যে একজনের নাম শোয়েব বলে জানা গেছে। এই ধরনের হুমকি কেবল সাংবাদিকদের নিরাপত্তার ওপর আঘাত নয়, বরং পেশাগত দায়িত্ব পালনেও সরাসরি হস্তক্ষেপ।
সাংবাদিকদের দৃঢ় প্রতিক্রিয়া ও গণপ্রতিবাদ
রাজনৈতিক নেতাদের এমন অগণতান্ত্রিক আচরণে কর্মরত সংবাদকর্মীরা তাৎক্ষণিক এবং দৃঢ় প্রতিক্রিয়া দেখান। সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে হুমকিদাতা ওই দুই নেতাকে পর্যটন মোটেলের বাইরে বের করে আনেন। দীর্ঘ সময় এনসিপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংবাদকর্মীদের উচ্চ বাক্য বিনিময় চলতে থাকে।
সংবাদকর্মীরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন এবং জড়িত দুই নেতার বিচার দাবি করেছেন। সাংবাদিকরা সম্মিলিতভাবে ঘোষণা দেন যে, এই ঘটনার সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া পর্যন্ত তাঁরা এনসিপির সকল কার্যক্রমে মিডিয়া কাভারেজ দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন। এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি সাংবাদিকদের পেশাগত সংহতি এবং স্বাধীনতার গুরুত্ব তুলে ধরে।
পুলিশের ভূমিকা ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ
ঘটনার খবর পেয়ে স্থানীয় পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকা উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ দুই পক্ষকে শান্ত করার চেষ্টা করে। এনসিপি নেতা ও বিক্ষুব্ধ সাংবাদিকদের মধ্যেকার উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় নিরসনে পুলিশকে বেশ বেগ পেতে হয়।
সন্ধ্যায় সংবাদকর্মীরা পর্যটন মোটেল এলাকা ছেড়ে এলেও, এনসিপি নেতাকর্মীরা সেখানেই অবস্থান নিয়ে বসে ছিলেন। পুলিশের উপস্থিতি আরও বড় ধরনের সংঘাত এড়াতে সাহায্য করে। এই ঘটনা প্রমাণ করে, রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ কোন্দল কীভাবে জনজীবনে এবং পেশাগত কার্যক্রমে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।
এনসিপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও নেতৃত্ব বিতর্ক
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) রাজশাহী জেলা কমিটি গঠন নিয়ে এই অভ্যন্তরীণ কোন্দলটি এখন প্রকাশ্যে চলে এলো। মহানগর কমিটির একাংশের নেতারা নবগঠিত জেলা কমিটির আহ্বায়ক সাইফুল আলমকে ‘আওয়ামী লীগের দোসর’ বলে অভিযোগ করেছেন। এই অভিযোগ মূলত বর্তমান রাজনৈতিক পটভূমিতে এনসিপির রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে দলের ভেতরেই মতপার্থক্যের ইঙ্গিত দেয়।
স্থানীয় রাজনীতিতে এনসিপির মতো একটি বিরোধী দলের অভ্যন্তরীণ বিভাজন তাদের সাংগঠনিক শক্তিকে দুর্বল করবে। নেতৃত্ব নিয়ে এই ধরনের বিতর্ক ও সংঘাত দলের ইমেজ ও জনসমর্থনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত, অভ্যন্তরীণ বিরোধকে সংঘাতের পথে না নিয়ে এসে গণতান্ত্রিক উপায়ে সমাধান করা।
সাংবাদিকের নিরাপত্তা ও পেশাগত স্বাধীনতা
সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হওয়া এবং তালা মেরে আগুন দেওয়ার হুমকি স্বাধীন সাংবাদিকতা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আঘাত। এমন একটি ঘটনা পেশাদার সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং কোনো প্রকার হুমকি বা আক্রমণের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নেওয়া প্রশাসনের দায়িত্ব।
সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধভাবে মিডিয়া কাভারেজ বর্জনের সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য একটি স্পষ্ট বার্তা যে, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত না হলে তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম জনগণের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হবে না। এই ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া স্বাধীন সাংবাদিকতার ভবিষ্যতের জন্য অপরিহার্য।
অস্থিতিশীলতা ও বিচারের দাবি
রাজশাহী পর্যটন মোটেলে এনসিপি’র দুই পক্ষের উত্তেজনা এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনা দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার আরেকটি উদাহরণ। দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল কীভাবে সহিংসতায় রূপ নিতে পারে, তার স্পষ্ট চিত্র এটি। সাংবাদিকদের ওপর চড়াও হওয়ার ঘটনায় তাদের দাবি অনুযায়ী দোষীদের বিচার নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। এই ঘটনার সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত এনসিপির প্রতি মিডিয়া কাভারেজ বর্জনের সিদ্ধান্ত বহাল থাকলে, দলটির রাজনৈতিক প্রচারে বড় ধরনের প্রভাব পড়বে।
এম আর এম – ২৪৪১,Signalbd.com



