কৃষি

রাঙামাটিতে জুমের ফসল: জীবিকা, ঐতিহ্য ও সংগ্রামের কৃষিসংস্কৃতি

Advertisement

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের বিস্তীর্ণ পার্বত্য এলাকায় হাজার বছরের পুরোনো কৃষিপদ্ধতির নাম জুমচাষ। পাহাড়ের ঢালু জমি পরিষ্কার করে—যা স্থানীয়ভাবে জুমিয়া বা জুমভূমি নামে পরিচিত—সেখানে মিলেট, ধান, বিভিন্ন শাকসবজি, কচু, মরিচ, তরমুজ, মিষ্টিকুমড়া, মিষ্টি আলু, আদা, হলুদ, কলা, আনারসসহ নানা ফসল চাষ করেন পাহাড়ের মানুষ। এই জমিই তাঁদের প্রধান খাবারের উৎস এবং বছরের বড় একটি সময় ধরে জীবিকার ভরসা।

রাঙামাটির শহর, গ্রাম আর নৌপথে এখন চোখে পড়ে জুমের সতেজ সব ফসল। বনরূপা বাজার, কুতুকছড়ি, সীতা পাহাড় কিংবা দূরবর্তী গ্রামগুলো—সব জায়গায় চলছে জুমের ফসল তুলতে ব্যস্ততার চিত্র। পাহাড়ি নারী-পুরুষেরা পাহাড় থেকে ফসল কেটে এনে বাজারে বিক্রি করছেন। কোথাও দারুণ ব্যস্ততা, কোথাও বা বিশ্রামের ফাঁকে পথের ধারে একটু জিরিয়ে নেওয়া। এই চিত্রই রাঙামাটির পাহাড়ি জনজীবনের অন্যতম পরিচয়।

ফটোসাংবাদিক সুপ্রিয় চাকমার তোলা সাম্প্রতিক কিছু ছবির ভিত্তিতে এবং জুমচাষ সম্পর্কিত বিস্তৃত তথ্য যোগ করে Signalbd.com এর জন্য তৈরি করা হলো এই বিশেষ প্রতিবেদন।

জুমচাষ: পাহাড়িদের নিত্যদিনের খাদ্যের প্রধান উৎস

জুমচাষ শুধু কৃষি নয়; এটি পাহাড়িদের জীবন, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত একটি শিকড়বদ্ধ পদ্ধতি। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে এটি হলো ‘শিফটিং কাল্টিভেশন’। পাহাড়ের ঢালে নির্দিষ্ট এলাকায় বনঝোপ পরিষ্কার করে এক মৌসুমের জন্য সেখানে বিভিন্ন ধরনের বীজ ছড়িয়ে দেওয়া হয়।

একটি জায়গায় সব ধরনের ফসল একসঙ্গে হয়—জুমের এটিই বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এখানে আলাদা আলাদা জমি তৈরি করতে হয় না, স্থায়ী সেচব্যবস্থাও নেই। বৃষ্টি, মাটি ও পাহাড়ি পরিবেশই ফসলের প্রধান সহায়ক।

চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াংসহ প্রায় সব আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কাছে জুমচাষ অত্যন্ত সম্মানিত ও ঐতিহ্যপূর্ণ একটি কৃষিপদ্ধতি।

বনরূপা বাজারে জুমের রঙিন পসরা

সকালের আলো ফুটতেই রাঙামাটির বনরূপা বাজারে জমতে থাকে পাহাড়ি নারীদের ভিড়।
ঝুড়ি, ডালা আর নৌকায় করে তাঁরা নিয়ে আসেন—

  • জুমের ধান
  • তাজা আনারস
  • করলা, বরবটি, লাউ, কুমড়া
  • কচু, মিষ্টি আলু
  • কলা
  • বন্য মরিচ
  • হলুদ ও আদা
  • বুনো শাক
  • জুমের বিশেষ ফসল মিলেট বা কাউন

নারীদের হাসি, হাতে রঙিন ঝুড়ি আর সামনে সাজানো অপরূপ সব ফসল—এই দৃশ্য এখন রাঙামাটির দৈনন্দিন জীবনের এক বিশেষ অংশ।

সীতা পাহাড়ে ব্যস্ত সময়: জুম ধান কাটার মৌসুম

সীতা পাহাড়ে এখন চলছে জুম ধান কাটার সময়। পাহাড়ি ভাষায় একে অনেকে ‘ফানদেং’ বা ‘ফান্দং’ নামে ডাকেন।

পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ওঠা-নামার মধ্যে কৃষিকাজ যতটা কঠিন, ততটাই ধৈর্য ও দক্ষতার প্রয়োজন। ধান কেটে শুকানোর পর মাড়াই করা হয় সম্পূর্ণ নিজস্ব ঐতিহ্যগত কায়দায়।
এই ধান বেশি সুগন্ধি, তুলনামূলক নরম এবং স্বাদেও অনন্য—এ কারণে বাজারে এর আলাদা চাহিদা রয়েছে।

কুতুকছড়ি গ্রামের মাঠে জীবিকা সংগ্রামের দৃশ্য

রাঙামাটির কুতুকছড়ি অঞ্চলে দেখা যায় পুরোদস্তর মাঠের কাজ। কেউ গাছ ছাঁটছেন, কেউ আগাছা পরিষ্কার করছেন, কেউ বা কাটা ফসল বাঁধছেন। প্রায় সব গ্রামেই পুরুষ-নারী সমানভাবে কাজ করেন। পাহাড়ে শ্রমশক্তির বড় অংশই নারী, বিশেষত কৃষিকাজে তাঁদের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

এ কারণে জুমচাষ শুধু অর্থনীতিই নয়, পাহাড়ি নারীর ক্ষমতায়নেরও গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।

নৌপথে আনারস: রাঙামাটির আরেক কৃষির সৌন্দর্য

নৌকায় করে বাজারে আনারস আনছে পাহাড়ি পরিবারগুলো—এমন দৃশ্য রাঙামাটির কর্ণফুলী নদী, কাপ্তাই লেক এবং বিভিন্ন ছড়ায় নিয়মিত দেখা যায়।
পাহাড়ি আনারস প্রাকৃতিকভাবে চাষ করা হয়, প্রায়ই জৈব সার ছাড়া। স্বাদে মিষ্টি, রসে টইটম্বুর। বাজারে এদের আলাদা মূল্য রয়েছে।

নৌপথই পাহাড়ি মানুষের প্রধান যোগাযোগ ব্যবস্থা। জুমের ফসল তুলেই অনেক পরিবার নৌকা চালিয়ে শহরের দিকে রওনা হন।

ঝুড়ি ভরা ফসল নিয়ে বাজারমুখী পাহাড়ি নারী

জুমচাষ মানে শুধু মাঠে কাজ নয়। পাহাড়ি নারীরা নিজেরাই ফসল তোলেন, গুছিয়ে নেন, বহন করেন, বাজারে নিয়ে যান, বিক্রি করেন—সবই সামলান।
জীবনযাত্রার এই কঠিন বাস্তবতার মধ্যেও তাঁদের চোখে থাকে আত্মবিশ্বাস।
প্রতিটি ঝুড়িতেই থাকে—

  • পাহাড়ের মাটির গন্ধ
  • ঋতুর রঙ
  • পরিশ্রমের গল্প
  • এবং জীবিকার আশা

কলা বিক্রিতে পথে পথে বিশ্রাম

জুমের সঙ্গে কলা অন্যতম প্রধান ফসল। অনেকসময় পরিবারগুলো কয়েক ঘণ্টা হেঁটে বা নৌকা বেয়ে বাজারে আসেন। পথের ক্লান্তিতে তারা একটু বিশ্রাম নেন রাস্তায় বসে।
তাদের কাছে বাজার শুধু ব্যবসা নয়; এটি স্থানীয় অর্থনীতির প্রাণ।

জুমের ফসলের জমজমাট বেচাকেনা: রাঙামাটির বাজার সংস্কৃতি

শহর ও উপজেলার বাজারগুলোতে এখন ভিড় জুম ফসল কিনতে আগত ক্রেতাদের।
পাহাড়ি আনারস, কলা, জুমশাক, ধান, আদা, হলুদ—সবকিছুই শহুরে মানুষের কাছে খুব জনপ্রিয়।

বিশেষ করে—

  • বুনো মরিচ
  • জুম লাউ
  • জুম কুমড়া
  • পাহাড়ি লেবু
  • মিষ্টি আলু
  • হলুদ

এগুলোর চাহিদা সারা বছরই থাকে।
অনেক জুমচাষী এখন অনলাইনেও ফসল বিক্রি করছেন। এতে তাঁদের আয় আরও বাড়ছে।

ফসল বিক্রি শেষে নৌকায় ঘরে ফেরা

ক্লান্ত দিনের শেষে যখন বাজারের কাজ শেষ হয়, তখন নৌকা চালিয়ে ঘরে ফেরেন চাষিরা।
কাপ্তাই লেকের পানির ওপর পড়া সূর্যের আলো, নৌকা বেয়ে চলার শব্দ, আর হাতে দিনের আয়—সব মিলিয়ে পাহাড়িদের দিনের এক শান্ত সমাপ্তি।

জুমচাষের সামাজিক-অর্থনৈতিক গুরুত্ব

জুমচাষ কেবল কৃষিকাজ নয়; এটি পাহাড়ি জীবনযাত্রার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। এর গুরুত্ব কয়েকটি দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—

১. খাদ্যনিরাপত্তার প্রধান উৎস

পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর খাদ্যের বড় অংশই জুমের ফসল থেকে আসে।

২. পাহাড়ি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ

জুমচাষের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে গান, নাচ, উৎসব, ক্যালেন্ডার এবং সামাজিক আচার।

৩. নারীশক্তির অংশগ্রহণ

পাহাড়ে কৃষিকাজে নারীর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য, যা অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নেও সহায়ক।

৪. স্থানীয় অর্থনীতির চাকা সচল রাখে

জুম ফসল বিক্রি করে বহু পরিবার সারা বছরের খরচ চালান।

৫. টেকসই কৃষিপদ্ধতি

যথাযথভাবে চক্রমান ব্যবস্থায় করলে জুম পরিবেশবান্ধব হতে পারে।

জুমচাষের চ্যালেঞ্জ

যদিও জুমের গুরুত্ব অপরিসীম, তবুও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে—

  • বনভূমির সংকোচন
  • জলবায়ু পরিবর্তন
  • পাহাড়ধসের ঝুঁকি
  • বাজারমূল্যের ওঠানামা
  • সঠিক কৃষিপরামর্শের অভাব
  • অদক্ষ পরিবহন ব্যবস্থা
  • জুমভূমি ব্যবহারে নীতিগত অস্পষ্টতা

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সরকার ও স্থানীয় প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে কাজ করলে জুমচাষ হতে পারে পাহাড়ের জন্য আধুনিক ও টেকসই কৃষির মডেল।

জুমচাষে নতুন সম্ভাবনা

সম্প্রতি কয়েকটি ক্ষেত্রে জুমচাষ নতুন সম্ভাবনার দিগন্ত খুলে দিয়েছে—

১. জৈব ও কীটনাশকমুক্ত ফসল হিসেবে বাজারে মূল্য বাড়ছে

শহুরে ভোক্তারা এখন জৈব পণ্যের দিকে ঝুঁকছেন।

২. অনলাইন মার্কেটিং বৃদ্ধি

ফেসবুক পেজ, কৃষি গ্রুপ, ওয়েবসাইট—সবমিলিয়ে বাজার আরও বিস্তৃত হয়েছে।

৩. পর্যটনের সঙ্গে সংযোগ

অনেকে জুমভূমি পরিদর্শনে আসেন। পাহাড়ের জীবনের গল্প জানতে চান। এতে স্থানীয়দের আয় বাড়ছে।

৪. গবেষণার নতুন পথ

কৃষি গবেষকরা এখন জুম পদ্ধতির উন্নয়ন নিয়ে আরও গবেষণা করছেন।

জুমচাষ শুধু পাহাড়িদের খাদ্যের উৎস নয়; এটি তাদের সংস্কৃতি, পরিচয়, ইতিহাস এবং জীবনের শক্ত ভিত্তি। পাহাড়ের মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে যে কৃষি পদ্ধতি গড়ে তুলেছেন, তা বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্থাকেও সমৃদ্ধ করেছে।

রাঙামাটির পাহাড়ে এখন জুমের ফসলের মৌসুম। পাহাড়ের ঢাল, নৌপথ, বাজার—সব জায়গায় ছড়িয়ে আছে পরিশ্রমের রঙ, সংগ্রামের গল্প আর জীবিকার সুখ-দুঃখ।
বাজারে ফসল বেচে ঘরে ফিরতে থাকা সেই নৌকার ভেতরেই বয়ে চলে পাহাড়িদের সারা বছরের আশা।

MAH – 14052 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button