বাংলাদেশ

জি-২০ সম্মেলনে দক্ষিণ আফ্রিকা নিষিদ্ধ: ট্রাম্পের ঘোষণার পাল্টা জবাব দিলেন রামাফোসা

Advertisement

আগামী বছর যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় অনুষ্ঠেয় জি-২০ (G20) শীর্ষ সম্মেলনে দক্ষিণ আফ্রিকাকে আমন্ত্রণ জানানো হবে না বলে ঘোষণা দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। জি-২০ জোটের সভাপতিত্ব হস্তান্তর নিয়ে কূটনৈতিক টানাপোড়েনের জেরে ট্রাম্প তার মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ বুধবার (২৬ নভেম্বর) এই নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেন। মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই ঘোষণাকে ‘দুঃখজনক’ বলে মন্তব্য করেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা এবং এর পাল্টা জবাবও দিয়েছেন।

ট্রাম্প দাবি করেছেন, চলতি বছর দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠিত জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন শেষে প্রিটোরিয়া ‘জি-২০ সভাপতিত্ব প্রতীকীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে’। এছাড়া তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ কৃষকদের ওপর ‘ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের’ অভিযোগ তুলেছেন। অন্যদিকে, প্রেসিডেন্ট রামাফোসা এক বিবৃতিতে ট্রাম্পের অভিযোগ খণ্ডন করে জানিয়েছেন, গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র অংশ না নেওয়ায় প্রথা অনুযায়ী মার্কিন দূতাবাসের কাছে সভাপতিত্বের সরঞ্জাম যথাযথভাবে হস্তান্তর করা হয়েছে। এই কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব আন্তর্জাতিক মহলে নতুন করে আলোচনা সৃষ্টি করেছে।

ট্রাম্পের ঘোষণার বিস্তারিত ও অভিযোগ

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঠিক কী বলেছেন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে তার প্রধান অভিযোগগুলো কী।

নিষিদ্ধের ঘোষণা: প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার ‘ট্রুথ সোশ্যাল’ প্ল্যাটফর্মে ঘোষণা করেন, ‘অতএব, আমার নির্দেশে আগামী বছর ফ্লোরিডার গ্রেট সিটি অব মিয়ামিতে অনুষ্ঠিতব্য জি-২০ সম্মেলনে দক্ষিণ আফ্রিকা আমন্ত্রণ পাবে না।’

সভাপতিত্ব হস্তান্তর নিয়ে অভিযোগ: ট্রাম্পের প্রধান অভিযোগ হলো, জোহানেসবার্গে জি-২০ সম্মেলন শেষে দক্ষিণ আফ্রিকা মার্কিন দূতাবাসের প্রতিনিধির কাছে জি-২০ সভাপতিত্ব হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। এটিকেই তিনি দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিষিদ্ধ করার কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন।

মানবাধিকার লঙ্ঘন: ট্রাম্প দাবি করেন, দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার শ্বেতাঙ্গ কৃষকদের এবং ডাচ, ফরাসি ও জার্মান বংশোদ্ভূতদের ওপর ঘটে যাওয়া ‘ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘন’ স্বীকার করে না। তিনি অভিযোগ করেন, দক্ষিণ আফ্রিকা ‘সোজা কথায়, তারা শ্বেতাঙ্গদের হত্যা করছে এবং তাদের খামার জোর করে দখল করতে দিচ্ছে।’

যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন: ট্রাম্প মন্তব্য করেন, দক্ষিণ আফ্রিকা দেখিয়ে দিয়েছে যে তারা ‘কোনো সংগঠনেরই সদস্য হওয়ার যোগ্য নয়।’

প্রেসিডেন্ট রামাফোসাদের পাল্টা জবাব

ট্রাম্পের অভিযোগের জবাবে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্টের বক্তব্য ও কূটনৈতিক অবস্থান।

দুঃখ প্রকাশ: প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার কার্যালয় ট্রাম্পের মন্তব্যে ‘দুঃখ প্রকাশ’ করেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতি: রামাফোসা তার বিবৃতিতে উল্লেখ করেন, সম্প্রতি শেষ হওয়া জি-২০ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণের কথা ছিল, ‘কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, তারা নিজেদের ইচ্ছায় জোহানেসবার্গে জি-২০ নেতাদের শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে’

সভাপতিত্ব হস্তান্তরের প্রক্রিয়া: রামাফোসা নিশ্চিত করেছেন যে, যেহেতু মার্কিন প্রতিনিধিদল সম্মেলনে অংশ নেয়নি, তাই ‘জি-২০ সভাপতিত্বের সরঞ্জাম দক্ষিণ আফ্রিকার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও সহযোগিতা বিভাগের সদর দফতরে মার্কিন দূতাবাসের একজন কর্মকর্তার কাছে যথাযথভাবে হস্তান্তর করা হয়েছে’

অংশগ্রহণকারীদের উল্লেখ: তিনি এও উল্লেখ করেছেন যে, কিছু মার্কিন ব্যবসায়ী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন।

জি-২০ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বের অবস্থান

চলতি বছর জোহানেসবার্গের সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র কেন অংশ নেয়নি এবং এর পেছনের কারণ।

অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকা: চলতি বছর দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র অংশ নেয়নি

অংশ না নেওয়ার কারণ: সে সময় ওয়াশিংটন বলেছিল যে, দক্ষিণ আফ্রিকার বাণিজ্য সহযোগিতা ও জলবায়ু ইস্যুসহ যেসব অগ্রাধিকার রয়েছে, তা মার্কিন নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়

কূটনৈতিক টানাপোড়েন: মূলত শ্বেতাঙ্গ কৃষকদের ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এবং জলবায়ু ইস্যু নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক টানাপোড়েন বিদ্যমান ছিল।

পাল্টা পদক্ষেপ: এই কারণেই দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা প্রথা অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের কাছে জি-২০ সভাপতিত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানান

বিতর্কের মূল কেন্দ্র: মানবাধিকার ও বর্ণবাদ

ট্রাম্পের শ্বেতাঙ্গ কৃষকদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এবং দক্ষিণ আফ্রিকার জবাব।

আফ্রিকানারদের সুরক্ষা: ট্রাম্প প্রশাসন এর আগেও দক্ষিণ আফ্রিকায় ইউরোপীয় বসতি স্থাপনকারীদের বংশধর আফ্রিকানারদের লক্ষ্য করে চালানো কথিত ‘শ্বেতাঙ্গ গণহত্যার’ অভিযোগ তুলেছিল।

দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিক্রিয়া: দক্ষিণ আফ্রিকা সরকার বরাবরই ট্রাম্পের এই অভিযোগকে ‘ভিত্তিহীন’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে। তারা জানিয়েছে যে, দেশে কোনো বর্ণবাদী সহিংসতা নেই এবং আইনের শাসন বিদ্যমান।

বর্ণবাদের ইতিহাস: দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসের সঙ্গে বর্ণবাদ (Apartheid) জড়িয়ে আছে। ট্রাম্পের অভিযোগ সেই পুরোনো ক্ষতকে উসকে দিচ্ছে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।

সিরিল রামাফোসা (কোট): “সম্প্রতি শেষ হওয়া জি-২০ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণের কথা ছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, তারা নিজেদের ইচ্ছায় জোহানেসবার্গে জি-২০ নেতাদের শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”

জি-২০ ও এর প্রাসঙ্গিকতা

জি-২০ জোট কী এবং দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিষিদ্ধ করার এই সিদ্ধান্তের আন্তর্জাতিক প্রভাব।

জি-২০ জোট: এটি বিশ্বের ‘২০টি বৃহত্তম অর্থনীতির দেশের’ সমন্বয়ে গঠিত একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক জোট, যা বৈশ্বিক অর্থনীতি ও নীতি নিয়ে কাজ করে।

আমন্ত্রণের নিয়ম: নিয়ম অনুযায়ী, জোটের সদস্য দেশগুলোকে সম্মেলনে আমন্ত্রণের প্রয়োজন নেই, তবে ভিসা বিধিনিষেধের মাধ্যমে তাদের অংশগ্রহণ আটকে দেওয়া যেতে পারে। ট্রাম্পের এই ঘোষণা একটি কূটনৈতিক নিষেধাজ্ঞা হিসেবেই দেখা হচ্ছে।

সম্মেলনের স্থান: ২০২৬ সালের জি-২০ সম্মেলন যুক্তরাষ্ট্রের মায়ামির ‘ট্রাম্প ন্যাশনাল ডোরাল গলফ রিসোর্টে’ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে, যা ট্রাম্প পরিবারের মালিকানাধীন। এর ফলে ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত কিছুটা ব্যক্তিগত স্বার্থ দ্বারা প্রভাবিত বলেও ধারণা করা হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতিতে নতুন ফাটল

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জি-২০ সম্মেলনে দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিষিদ্ধ করার ঘোষণাটি আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতিতে একটি নতুন ফাটল তৈরি করেছে। জি-২০-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক মঞ্চে এমন একটি সদস্য দেশকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত জোটের ঐক্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার পাল্টা জবাবে স্পষ্ট যে, সভাপতিত্ব হস্তান্তর নিয়ে ট্রাম্পের অভিযোগ ভিত্তিহীন। ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত মূলত শ্বেতাঙ্গ কৃষকদের মানবাধিকার ইস্যুতে তার পুরোনো অভিযোগ এবং প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজের কর্তৃত্ব জাহির করার একটি চেষ্টা বলেই মনে করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। এই সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে, আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে এখনও ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক মতাদর্শ কীভাবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ফোরামের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করতে পারে। জি-২০ জোটের বাকি সদস্য দেশগুলো এই পরিস্থিতিতে কী অবস্থান নেয়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

এম আর এম – ২৩৯৬,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button