বঙ্গোপসাগরের অদূরে মাছ ধরতে যাওয়া দুই ট্রলারসহ ১২ বাংলাদেশি জেলেকে মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (AA) অপহরণ করেছে। ভোররাত সেন্ট মার্টিনের ছেঁড়াদিয়ার পূর্বাঞ্চলে এ ঘটনা ঘটে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রথম ট্রলারের মালিক সেন্ট মার্টিনের বাসিন্দা নুর মোহাম্মদ বলেন, “বুধবার আমাদের ট্রলারটি মাছ ধরতে সেন্ট মার্টিনের ছেঁড়াদিয়া এলাকায় যায়। আমার ট্রলারের সঙ্গে ছিল ছয়জন জেলে, তবে ইঞ্জিন বিকল হয়ে যাওয়ায় ট্রলার সাময়িকভাবে সমুদ্রে আটকে যায়। বৃহস্পতিবার ভোরে খবর আসে, আমাদের জেলেদের আরাকান আর্মি ধরে নিয়ে গেছে।”
অপর ট্রলারটির মালিক স্থানীয় ইলিয়াস মাঝি জানিয়েছেন, “আমাদের ট্রলারও একইভাবে অপহরণ হয়েছে। মাছ ধরার সময় যে ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়, তা স্থানীয় জেলেদের মাঝে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।”
আরাকান আর্মির পূর্ব ইতিহাস এবং বাংলাদেশি জেলেদের অপহরণ
মিয়ানমারভিত্তিক অনলাইন সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল আরাকান নেটওয়ার্ক জানায়, আরাকান আর্মি সম্প্রতি তাদের উপকূলীয় নিরাপত্তা ইউনিট সক্রিয় করেছে। গত ২৮ অক্টোবর থেকে তারা সমুদ্র পথে টহল জোরদার করেছে। টহলের সময় আরাকান রাজ্যের জলসীমা অতিক্রম করে মাছ ধরতে থাকা কয়েকটি বাংলাদেশি ট্রলার শনাক্ত করা হয়।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১৮ জুলাই পর্যন্ত প্রায় ১৮৮ জন বাংলাদেশি জেলে এবং ৩০টি নৌকা আটক করা হয়েছিল। পরে বেশিরভাগ জেলেকে মুক্তি দেওয়া হলেও, Thursday, ২৭ নভেম্বর দুটি ট্রলারসহ ১২ জন জেলেকে আটক করার ঘটনা ঘটেছে।
সেন্ট মার্টিন ফিশিং ট্রলার সমবায় সমিতির সভাপতি আজিম উদ্দিন বলেন, “বিভিন্ন সময় মাছ ধরতে যাওয়া জেলেদের প্রায় দেড় শতাধিকবার আটক করেছে আরাকান আর্মি। এই জেলেরা এখনো তাদের হেফাজতে রয়েছে। তাদের মুক্তি বা ফেরার বিষয়ে এখনো কোনো নিশ্চয়তা পাওয়া যায়নি।”
টেকনাফ উপজেলা প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ এহসান উদ্দিন জানিয়েছেন, “অপহৃত জেলেদের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবহিত করা হয়েছে। আমরা বিজিবি এবং অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে দ্রুত কার্যক্রম গ্রহণ করছি।”
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং স্থানীয় প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ মাসে অন্তত ৩৭৮ জন জেলেকে আরাকান আর্মি অপহরণ করেছে। এর মধ্যে প্রায় ২০০ জনকে বিজিবি ও স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় কয়েক দফায় উদ্ধার করা হয়েছে। তবে এখনও ১৭৮ জন জেলে আরাকান আর্মির হাতে বন্দি রয়েছে।
সেন্ট মার্টিন ও টেকনাফের জেলেদের অনিশ্চয়তা
জেলেরা সাধারণত মাছ ধরার জন্য সেন্ট মার্টিন এবং টেকনাফের সমুদ্রপথ ব্যবহার করে। কিন্তু সম্প্রতি আরাকান আর্মির ক্রমবর্ধমান টহল ও অপহরণের কারণে তাদের জীবন ও নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে।
সেন্ট মার্টিনের স্থানীয় জেলেরা জানান, “প্রতিদিন সমুদ্রে যাত্রা করা আমাদের জন্য বিপদজনক হয়ে উঠেছে। আমরা কখনো জানি না যে, ফেরার পথে আবার কেউ আমাদের ধরে নেবে কি না।”
অন্যদিকে, স্থানীয় ফিশিং ট্রলার মালিকরা জানিয়েছেন, “আমাদের ট্রলারগুলো শুধু মাছ ধরতেই ব্যবহার হয়। কিন্তু এসব অপহরণ আমাদের ব্যবসার উপর গভীর প্রভাব ফেলছে। জেলেরা ভীত, পরিবারেরাও আতঙ্কিত।”
আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ
বিশ্লেষকরা বলছেন, মিয়ানমারের আরাকান আর্মির এই ধরনের কার্যক্রম দুই দেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে জেলেদের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে ফেলছে। বিশেষ করে বাংলাদেশি জেলেদের ওপর অর্থনৈতিক ও মানসিক চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
গ্লোবাল আরাকান নেটওয়ার্কের তথ্য অনুযায়ী, এই ধরনের অপহরণ মূলত আরাকান রাজ্যের জলসীমা রক্ষার উদ্দেশ্যে করা হলেও, এতে বাংলাদেশি জেলেরা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হচ্ছে। এছাড়া, বহু জেলের পরিবার আর্থিক ও সামাজিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশ সরকারের পদক্ষেপ
বাংলাদেশ সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসন ইতোমধ্যেই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে। বিজিবি, কোস্টগার্ড এবং স্থানীয় প্রশাসন জেলেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, “আমরা নিয়মিত আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। পাশাপাশি সমুদ্রপথে বাংলাদেশের জেলেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য টহল ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।”
জেলেদের পরিবার ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের উদ্বেগ
জেলেদের পরিবারগুলো গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে। তাদের মতে, অপহৃত জেলেরা সমুদ্রে নিখোঁজ হওয়া এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি। তাদের পরিবার জানাচ্ছে, “আমরা সরকারের কাছে দ্রুত পদক্ষেপের আবেদন করছি। আমরা চাই আমাদের স্বামী, ভাই ও ছেলে যেন দ্রুত নিরাপদে ফিরে আসে।”
স্থানীয়রা আরও বলেছেন, “এই ধরনের ঘটনার ফলে শুধু জেলেদের জীবনই বিপন্ন হচ্ছে না, সমুদ্রপথে মাছ ধরার অর্থনৈতিক কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সেন্ট মার্টিন ও টেকনাফ অঞ্চলে মাছের ব্যবসা বিশাল আকার ধারণ করেছে। যদি জেলেরা নিরাপদে কাজ করতে না পারে, তাহলে পুরো অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
সমুদ্র নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাংলাদেশের উপকূলবর্তী জেলেদের সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন এবং দ্বিপাক্ষিক সমঝোতার মাধ্যমে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
তারা বলছেন, “বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সীমান্ত সুরক্ষা, টহল ব্যবস্থা এবং জেলেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।”
অপরদিকে, সেন্ট মার্টিন ফিশিং ট্রলার সমবায় সমিতির সভাপতি আজিম উদ্দিন বলেন, “জেলেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আরও আধুনিক নৌকা ও ইঞ্জিন, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং জরুরি সাহায্য ব্যবস্থা প্রয়োজন।”
বাংলাদেশি জেলেদের জন্য সমুদ্রপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন এক জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সম্প্রতি দুই ট্রলারসহ ১২ জেলেকে আটক করা আরাকান আর্মির ঘটনায় স্থানীয় জেলেরা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে। সরকারের তৎপরতা এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ জেলেদের মুক্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
জেলেদের দ্রুত মুক্তি ও নিরাপদ সমুদ্রপথ নিশ্চিত করা হলে কক্সবাজার, টেকনাফ এবং সেন্ট মার্টিন অঞ্চলের অর্থনীতি ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা পুনরায় স্থিতিশীল হবে।
MAH – 14028 I Signalbd.com



