বিশ্ব

গাজায় টানেল থেকে নিরাপদে বের হওয়ার সুযোগ চায় হামাস যোদ্ধারা

Advertisement

গাজা উপত্যকার জটিল যুদ্ধ বাস্তবতায় নতুন করে তীব্রতা এসেছে হামাসের এক প্রকাশ্য বিবৃতির মাধ্যমে। সংগঠনটি জানিয়েছে, তাদের বহু যোদ্ধা বর্তমানে গাজার ভূগর্ভস্থ টানেল ব্যবস্থায় আটকা রয়েছেন এবং সেখানে তারা জীবন-মরণের চাপে পড়েছেন। এই অবস্থায় তারা নিরাপদে বের হয়ে আসার জন্য আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারীদের সাহায্য চেয়েছে।

ফিলিস্তিনের এই সশস্ত্র স্বাধীনতাকামী সংগঠনটি প্রথমবারের মতো স্বীকার করেছে যে তাদের বহু যোদ্ধা টানেল গহ্বরে আটকা পড়েছেন—যা গাজার যুদ্ধ পরিস্থিতিকে আরও জটিল ও অনিশ্চিত করে তুলেছে।

জিও নিউজের প্রতিবেদনসহ আঞ্চলিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম বিষয়টি সামনে এনেছে।

টানেলের ভেতর ভয়াবহ চাপ: ২০ জনের বেশি যোদ্ধা নিহত, আটক ৮

গত সপ্তাহে গাজার রাফাহ অঞ্চলের টানেল নেটওয়ার্ক থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছিলেন হামাসের একদল যোদ্ধা। কিন্তু ইসরাইলি সেনাবাহিনী তাদের গতিবিধি আগে থেকেই পর্যবেক্ষণ করছিল। বের হওয়া মাত্রই তারা লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। এতে ২০ জনের বেশি যোদ্ধা নিহত হন, এবং আরও অন্তত আট জনকে জীবিত অবস্থায় গ্রেপ্তার করে ইসরাইলি বাহিনী।

এই ঘটনার পরই বুধবার হামাস এক জরুরি বিবৃতি প্রকাশ করে—যেখানে মধ্যস্থতাকারী দেশগুলোকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।

হামাসের বিবৃতি: ‘আমাদের সন্তানদের নিরাপদে ফিরতে দিতে হবে’

বিবৃতিতে হামাস সরাসরি ইসরাইলকে দায়ী করে জানায়—

“আমরা আমাদের যোদ্ধাদের প্রাণহানির জন্য ইসরাইলকে সম্পূর্ণ দায়ী করছি। মধ্যস্থতাকারী দেশগুলোকে অবিলম্বে পদক্ষেপ নিয়ে আমাদের সন্তানদের নিরাপদে ঘরে ফিরতে দিয়েছে এমন চাপ সৃষ্টি করতে হবে।”

এখানে “সন্তান” শব্দটি দিয়ে তারা নিজেদের যোদ্ধাদেরই বোঝায়—যা হামাসের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের আবেগজাত ও মানবিক উদ্দেশ্যকেও প্রতিফলিত করে।

প্রথম স্বীকারোক্তি: টানেলে আটকা শতাধিক যোদ্ধা

ইসরাইলি গণমাধ্যমের একাধিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাফাহ শহরের নিচে বিস্তৃত টানেল নেটওয়ার্কে বর্তমানে ১০০ থেকে ২০০ হামাস যোদ্ধা আটকা পড়ে আছেন।
ইসরাইলি বাহিনী সে এলাকায় ঘাঁটি স্থাপন করায় তারা বের হওয়ার কোনো নিরাপদ পথ পাচ্ছেন না।

গাজার নিচের এই টানেলগুলোকে দীর্ঘদিন ধরে হামাসের কৌশলগত শক্তি হিসেবে দেখা হয়। সরঞ্জাম পরিবহন, যোদ্ধাদের অবস্থান পরিবর্তন, এবং ইসরাইলি নজরদারি এড়াতে টানেল ব্যবস্থার বড় ভূমিকা আছে। কিন্তু চলমান যুদ্ধবিরতির আংশিক অবস্থা ও ইসরাইলের রাফাহ অভিযানের কারণে টানেলগুলো এখন ফাঁদে পরিণত হয়েছে।

যুদ্ধবিরতি চলছে, তবুও গাজায় নিয়মিত বোমাবর্ষণ

১০ অক্টোবর থেকে মার্কিন মধ্যস্থতায় ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে আংশিক যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। সমঝোতার শর্ত অনুসারে—

  • ইসরাইলি সেনারা উপকূলীয় কিছু অঞ্চল থেকে সরে যায়
  • তারা তথাকথিত ‘হলুদ রেখা’-তে অবস্থান নেয়
  • মানবিক সহায়তা প্রবেশের জন্য কিছু বিরতি দেয়া হয়

কিন্তু যুদ্ধবিরতিকে কেন্দ্র করেও বিভিন্ন জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। গাজার বাসিন্দারা প্রত্যাশিত শান্তি পাননি। বরং স্থানীয় সূত্র মতে, যুদ্ধবিরতির মাঝেও ইসরাইল গাজায় নিয়মিত বিমান হামলা ও সীমিত স্থল অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে।

বিশেষ করে রাফাহ শহরের আশপাশ এলাকা—যেখানে টানেল নেটওয়ার্কের ঘনত্ব বেশি—সেই স্থানগুলোতেই হামলার পরিমাণ সবচেয়ে বেশি বলে উল্লেখ করা হচ্ছে।

কেন হামাসের যোদ্ধারা টানেলে আটকা? বিশ্লেষণে উঠে আসছে তিনটি কারণ

নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, হামাস যোদ্ধাদের টানেলে আটকা পড়ার কারণ তিনটি—

১. টানেল ধ্বংস করতে ইসরাইলের ঘন আগ্রাসন

ইসরাইল বহু বছর ধরেই গাজার টানেলগুলোকে তাদের নিরাপত্তার জন্য ‘সবচেয়ে বড় হুমকি’ হিসেবে দেখে।
২০২৫ সালের এই সামরিক অভিযানে তারা টানেল ধ্বংস নীতি আরও ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করছে।

বোমা, সেন্সর, ড্রোন, এবং বিশেষ ধরনের শকওয়েভ বোমা ব্যবহার করে টানেল ভেঙে ফেলার চেষ্টা চলছে।

২. টানেলের বায়ুপ্রবাহ বন্ধ হওয়া

অনেক টানেলের ভেন্টিলেশন সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে ভেতরে থাকা যোদ্ধারা শ্বাসকষ্ট, পানি সংকট ও খাদ্যাভাবের মতো তীব্র সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন।

৩. উপরের এলাকায় ইসরাইলি বাহিনীর অবস্থান

যোদ্ধারা বের হওয়ার চেষ্টা করলেই ইসরাইলি সেনাদের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। রাফাহ এলাকায় গত এক মাস ধরে ইসরাইল ব্যাপক নজরদারি স্থাপন করেছে।

মধ্যস্থতা কারা করছে?

এই সংকটে সবচেয়ে সক্রিয় মধ্যস্থতাকারী তিন দেশঃ

  • কাতার
  • মিশর
  • যুক্তরাষ্ট্র

এই তিন দেশই হামাস ও ইসরাইলের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে।
তবে ইসরাইল এখনো হামাসের যোদ্ধাদের বের হওয়ার অনুমতি দিতে আগ্রহী নয়। তাদের দাবি—
“টানেলে যারা আছে, তারা সশস্ত্র যোদ্ধা। নিরাপদে বের হতে হলে অস্ত্র সমর্পণ করতেই হবে।”

হামাস এখনো প্রকাশ্যে অস্ত্র সমর্পণের বিষয়ে কোনো অবস্থান নেয়নি।

গাজার সাধারণ মানুষের দুর্দশা আরও বেড়েছে

যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও অবরুদ্ধ গাজায় মানবিক সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে।
সংস্থাগুলোর প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে—

  • খাদ্য সংকট চরম পর্যায়ে
  • হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সামগ্রী শেষ
  • রাফাহ ও খান ইউনুস এলাকায় মানুষ টানেলের ভেতর সংঘর্ষের শব্দে আতঙ্কে
  • পানি ও বিদ্যুৎ সংকট প্রকট
  • ত্রাণ প্রবেশ কমে গেছে

টানেল এলাকাগুলোতে হামলা থামছে না বলে স্থানীয়রা নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র পালাচ্ছেন।

হামাসের টানেল কৌশল: ইতিহাস ও গুরুত্ব

হামাসের টানেল নেটওয়ার্ক গাজায় বহু বছর ধরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় আছে।
এগুলো নির্মাণের ইতিহাস প্রায় দুই দশক পুরোনো।

টানেলের উদ্দেশ্য

  • ইসরাইলি বিমান হামলা থেকে রক্ষা পাওয়া
  • যুদ্ধের সময় কৌশলগত অবস্থান বদল করা
  • অস্ত্র ও খাদ্য পরিবহন
  • ইসরাইলের নজরদারি ব্যবস্থাকে বিভ্রান্ত করা

কিন্তু ২০২৫ সালের ইসরাইলি অভিযান এই নেটওয়ার্ককে কঠিন পরীক্ষায় ফেলেছে। এখন এই টানেলগুলো যোদ্ধাদের জন্য আশ্রয় না হয়ে বরং বিপদের কারণ হয়ে উঠেছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ধীরে ধীরে বাড়ছে

হামাসের এই বিবৃতির পর মধ্যপ্রাচ্য ও আন্তর্জাতিক মহলে আলোচনার ঝড় উঠে গেছে। কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থা বলছে—

  • আটকা যোদ্ধাদের জীবন রক্ষাও মানবাধিকারের অংশ
  • টানেলে বেসামরিক লোকও থাকতে পারে
  • ভূগর্ভস্থ লড়াই আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘনের ঝুঁকি বাড়ায়

জাতিসংঘ এখনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি—তবে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।

ইসরাইলের অবস্থান আরও কঠোর হচ্ছে

ইসরাইল বলছে—

“হামাস টানেল ব্যবস্থাকে সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত করেছে।
যোদ্ধারা সেখানে থাকলে অভিযান চলবেই।”

ইসরাইলি সামরিক সূত্র জানায়, তারা রাফাহ অঞ্চলে টানেলের ৩০ শতাংশের বেশি অংশ শনাক্ত করেছে এবং ধ্বংস প্রক্রিয়া চলমান।

পরিস্থিতি কোনদিকে যাবে? বিশ্লেষকদের মতামত

মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষকদের মতে, পরিস্থিতি তিনভাবে মোড় নিতে পারে—

১. মধ্যস্থতায় কিছু যোদ্ধা নিরাপদে বের হতে পারবে

এটি খুবই কঠিন, তবে অসম্ভব নয়—বিশেষত যদি যুক্তরাষ্ট্র মানবিক চাপ সৃষ্টি করে।

২. টানেলে বড় ধরনের অভিযান হতে পারে

ইসরাইল সরাসরি টানেলে নেমে অভিযান চালাতে পারে—যা আরও ভয়াবহ প্রাণহানির কারণ হবে।

৩. টানেল ধ্বংসের চাপ বাড়বে

ইসরাইল ধ্বংসযজ্ঞ বাড়ালে টানেলে থাকা যোদ্ধা এবং সাধারণ মানুষের জীবন ঝুঁকি আরও বাড়বে।

গাজার ভবিষ্যৎ: শান্তির পথ আরও দূরে?

যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও গাজায় শান্তি ফেরেনি। টানেল সংকট নতুন করে বড় জটিলতা তৈরি করেছে—যা মধ্যপ্রাচ্যের বিস্তৃত ভূরাজনীতিতে বড় ধরনের চাপ বাড়াতে পারে।

হামাস যোদ্ধাদের আটকে পড়া শুধু সামরিক ইস্যু নয়—এটি গাজার মানবিক সংকট, রাজনৈতিক আলোচনা, এবং ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা ব্যবস্থার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত।

হামাসের যোদ্ধারা টানেল থেকে নিরাপদে বের হওয়ার সুযোগ চাইছে—এটি কেবল তাদের অস্তিত্ব সংকট নয়, বরং গোটা গাজার মানুষের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা, মানবাধিকার এবং মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতার প্রশ্ন।

দুই পক্ষের অবস্থান কঠোর হওয়ায় পরিস্থিতি আরও অনিশ্চিত হয়ে উঠছে।
এখন বিশ্ব তাকিয়ে আছে মধ্যস্থতাকারী দেশগুলোর দিকে—তাদের সিদ্ধান্তই নির্ধারণ করবে টানেলে আটকে থাকা মানুষের জীবন বাঁচবে কি না, আর গাজায় সহিংসতা কমবে কি আরও বাড়বে।

MAH – 14019 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button