বিশ্ব

হংকং অগ্নিকাণ্ড: ১৮ ঘণ্টা পরও আগুন, মৃতের সংখ্যা ৪৪

Advertisement

হংকংয়ের ইতিহাসে অন্যতম বড় অগ্নিকাণ্ড

হংকং–চায়নার উত্তরাঞ্চলীয় একটি বিশাল হাউজিং কমপ্লেক্সে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পুরো অঞ্চলজুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। আগুন লাগার প্রায় ১৮ ঘণ্টা পরও আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস। বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় বিকেল ৩টার দিকে আগুনের সূত্রপাত হলেও ভোর পর্যন্তও আগুন জ্বলতে থাকে অন্তত চারটি ভবনে।

এই অগ্নিকাণ্ডে এখন পর্যন্ত ৪৪ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করেছে স্থানীয় প্রশাসন। এছাড়া নিখোঁজ রয়েছেন অন্তত ২৭৯ জন বাসিন্দা। আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি আছেন শতাধিক মানুষ, যাদের কয়েকজনের অবস্থা অত্যন্ত সংকটজনক।

দেশটির গত ৮০ বছরের ইতিহাসে এটিকে সবচেয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড হিসেবে উল্লেখ করেছেন হংকংয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তারা।

আটটি ব্লকের মধ্যে চারটিতে আগুন নিয়ন্ত্রণে, বাকি চারটি ব্লক এখনও ঝুঁকিতে

অগ্নিকাণ্ডের পরপরই ৭০০–র বেশি ফায়ার সার্ভিস কর্মী ঘটনাস্থলে মোতায়েন করা হয়। দ্রুততার সঙ্গে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালানো হলেও ব্যাপক ধোঁয়া, তীব্র উত্তাপ ও ব্লকগুলোর কাঠামোতে বাধা থাকার কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে ওঠে। আটটি ২৫ তলা ব্লকের প্রতিটিতে শত শত অ্যাপার্টমেন্ট ছিল, যেগুলোর অধিকাংশে বয়স্ক মানুষের বসবাস।

প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, চারটি ব্লকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসলেও বাকি ব্লকগুলোতে অগ্নিকাণ্ড ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে কারণ ভবনগুলোর চারপাশে নির্মাণ শ্রমিকদের কাজের জন্য বাঁশের তৈরি অস্থায়ী মাচা ছিল, যা মুহূর্তেই আগুন ধরে যায় এবং আগুন পুরো ব্লকে ছড়িয়ে যায়।

ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, এই ধরনের পুরোনো হাউজিং কমপ্লেক্সে বাঁশের মাচা আগুন ছড়িয়ে পড়ার সবচেয়ে বড় ঝুঁকি তৈরি করে।

নিখোঁজ ২৭৯ মানুষ: পরিবারগুলোর কান্না, অসহায় অপেক্ষা

ফায়ার সার্ভিস উদ্ধারকাজ চালিয়ে গেলেও ধোঁয়া কম না থাকায় বিস্তৃত অনুসন্ধান পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেক অ্যাপার্টমেন্টেই এখনো প্রবেশ করা যায়নি। ফলে নিখোঁজ মানুষের প্রকৃত সংখ্যা বাড়তে পারে বলে মনে করছে প্রশাসন।

নিখোঁজদের স্বজনেরা কাছে স্থাপিত অস্থায়ী হেল্প–ডেস্কে ভিড় করছেন। তাদের অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। কেউ কেউ জানিয়েছেন যে, আগুন লাগার সময় তাদের পরিবার সদস্যরা ঘরেই ছিলেন, কিন্তু ফোনে আর যোগাযোগ সম্ভব হয়নি।

হংকং প্রশাসন জানিয়েছে, নিখোঁজদের খোঁজে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত উদ্ধারকারী দল ড্রোন, থার্মাল ক্যামেরা ও রোবট ব্যবহার করছে।

বয়স্কদের আবাস: তাই মৃত্যু ও নিখোঁজের সংখ্যা বেশি

এই হাউজিং কমপ্লেক্সে প্রায় ৪,৬০০ মানুষের বসবাস ছিল। স্থানটি মূলত বয়স্ক নাগরিকদের জন্যই নির্মিত। গত কয়েক মাস ধরে ভবনগুলোর সংস্কার কাজ চলছিল। তাই অনেক বাসিন্দা অস্থায়ীভাবে থাকা–খাওয়া পরিবর্তন করেছিলেন। কতজন মানুষ আসলে সেখানে ছিলেন—তা নিশ্চিত করে বলতে পারছে না কর্তৃপক্ষ।

বয়স্কদের অনেকে হাঁটতে বা সিঁড়ি বেয়ে নামতে অক্ষম হওয়ায় আগুন লাগার পর তারা আটকা পড়ে যায় বলে মনে করা হচ্ছে। ভবনগুলোর বেশিরভাগ ফ্লোরেই ধোঁয়ায় দম আটকে বহু মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে।

আগুন লাগার কারণ এখনও অজানা

তদন্ত কমিটি জানায়, আগুন লাগার উৎস এখনও চিহ্নিত করা যায়নি। তবে কর্তৃপক্ষ ধারণা করছে,

১. মাচায় থাকা দাহ্য পদার্থ
২. নির্মাণকাজে ব্যবহৃত ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি
৩. ভবনের পুরোনো বৈদ্যুতিক লাইন

—এই তিনটির যেকোনো একটি থেকে আগুন ছড়িয়ে থাকতে পারে।

তদন্ত চলমান থাকায় বিস্তারিত তথ্য এখনও প্রকাশ করা হয়নি।

তবে দায়িত্বে অবহেলের অভিযোগে তিনজন নির্মাণকর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। ধারণা করা হচ্ছে, তারা নিরাপত্তা নীতিমালার বাইরে গিয়ে ভেতরে কাজ করছিল।

ফায়ারফাইটারদের ত্যাগ: আগুন নেভাতে গিয়ে প্রাণ হারালেন একজন সদস্য

আগুন নেভাতে গিয়ে একজন ফায়ার সার্ভিস কর্মী দম আটকে মারা যান। তার সহকর্মীরা জানান, ধোঁয়ায় দৃশ্যমানতা শূন্যের কাছাকাছি থাকায় উদ্ধারকারী দলের কাজ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছিল।

এই ঘটনায় শোক প্রকাশ করেছে হংকংয়ের ফায়ার সার্ভিস বিভাগ এবং তাদের পরিবারকে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে।

হাসপাতালে আহতদের চিকিৎসা

হাসপাতালগুলোতে আহতদের ভিড় উপচে পড়েছে। অনেকেই দগ্ধ হয়েছেন, অনেকের আবার ধোঁয়ায় শ্বাসকষ্ট হয়েছে। বিভিন্ন হাসপাতালে ‘জরুরি সেবা কোড রেড’ ঘোষণা করা হয়েছে।

চিকিৎসকরা জানান, কিছু দগ্ধ রোগীর অবস্থা অত্যন্ত সংকটাপন্ন। অনেকের শরীরের ৭০ শতাংশেরও বেশি পুড়ে গেছে।

অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে

আগুন লাগার পরই আশেপাশের কয়েকটি ভবন খালি করে দেয়া হয়। বাসিন্দাদের কাছের স্কুল, কমিউনিটি সেন্টার ও সরকারি ভবনে অস্থায়ী আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। সেখানে খাবার, পানি, চিকিৎসা এবং মানসিক সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

হংকং সামাজিক কল্যাণ বিভাগ জানিয়েছে, নিখোঁজদের পরিবারের জন্য বিশেষ কাউন্সেলিং টিম গঠন করা হয়েছে।

বিশ্বনেতাদের শোক প্রকাশ

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এ দুর্ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন এবং দ্রুত উদ্ধারকাজে প্রয়োজনীয় সহায়তার নির্দেশ দিয়েছেন।

এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশের নেতারা শোকবার্তা পাঠিয়েছেন।

জাতিসংঘও এক বিবৃতিতে নিহতদের জন্য সমবেদনা জানায় এবং আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করে।

স্থানীয় মানুষের ক্ষোভ: “নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ছিল বড় ত্রুটি”

ঘটনাস্থলে জড়ো হওয়া বাসিন্দারা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরে ভবনগুলোর অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা অকার্যকর ছিল। অ্যালার্ম সিস্টেমের ত্রুটি নিয়ে তারা প্রশাসনকে বারবার অভিযোগ জানালেও যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হয়নি বলে দাবি করেছেন।

অনেকে বলেন, নির্মাণকাজের সময় নিয়মিত নিরাপত্তা মহড়া বা অগ্নিনিরাপত্তা পরীক্ষা করা হয়নি।

এই অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখতে প্রশাসন বিশেষ তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

হংকংয়ে অতীতে বড় অগ্নিকাণ্ডের উদাহরণ

বিশ্লেষকদের মতে, হংকং–এ অতীতে এমন ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড একাধিকবার ঘটেছে, তবে এবারের ঘটনাটি মাত্রার দিক থেকে সর্বোচ্চ। অতীতের বড় অগ্নিকাণ্ডগুলো হলো:

১. ১৯৫৩ সালের শেক কিপ মেই আগুন: ৫০ হাজার মানুষ গৃহহীন
২. ১৯৯৬ সালের অ্যাপার্টমেন্ট আগুন: ৪১ জন নিহত
৩. ২০১১ সালের উডস্টক বিল্ডিং আগুন: ১১ জন নিহত

কিন্তু এবার আটটি ব্লকের বিশাল হাউজিং কমপ্লেক্সে আগুন লাগায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও ভয়াবহ।

প্রযুক্তিগত ব্যর্থতা নাকি মানবসৃষ্ট দুর্ঘটনা?

এই প্রশ্নটি এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে,

  • নির্মাণের সময় অনুমোদনহীন বৈদ্যুতিক লাইন ব্যবহার,
  • অগ্নিনিরাপত্তা যন্ত্রের রক্ষণাবেক্ষণের ঘাটতি,
  • অত্যধিক পুরোনো ভবন,
  • এবং জরুরি সিঁড়ির অব্যবস্থাপনা—

এই সব মিলিয়ে এত বড় দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

অগ্নিকাণ্ডের পর দেখা যায়, ভবনের বেশ কিছু ইমার্জেন্সি এক্সিটে নির্মাণসামগ্রী রাখা ছিল, যা বাসিন্দাদের বের হতে বাধা দেয়।

আগুন নেভাতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের চেষ্টা

ফায়ার সার্ভিস এ দুর্ঘটনায় প্রথমবারের মতো বিশেষ থার্মাল ড্রোন ব্যবহার করে আগুনের তাপমাত্রা নির্ণয় করছে। পাশাপাশি দূরনিয়ন্ত্রিত রোবটও ভবনে পাঠানো হয়েছে, যাতে উদ্ধারকাজের ঝুঁকি কমে।

তবে এত ঘন ধোঁয়ার কারণে এই প্রযুক্তিগুলোর কার্যকারিতা সীমিত হয়ে পড়েছে।

আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে আরও সময় লাগতে পারে

ফায়ার সার্ভিসের বরাত দিয়ে স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, আগুন পুরোপুরি নিভতে আরও ১০–১২ ঘণ্টা সময় লাগতে পারে। ব্লকগুলোর ফ্লোরগুলোতে এখনো দাহ্য পদার্থ রয়েছে, যা মাঝেমধ্যে আবার জ্বলে উঠছে।

আশেপাশের এলাকার গ্যাস–লাইন ও বিদ্যুৎ–লাইন সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

অগ্নিকাণ্ডের ছায়া: শহরজুড়ে আতঙ্ক ও অসহায়তা

অগ্নিকাণ্ডের পর পুরো এলাকায় দমবন্ধ করা ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। অনেক দোকান–পাট বন্ধ রাখা হয়েছে। জরুরি সেবা ছাড়া এলাকাটি প্রায় বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে।

শিশু ও বয়স্কদের মধ্যে শ্বাসকষ্টের সমস্যা বাড়ায় স্থানীয় চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোতে ভিড় দেখা গেছে।

তদন্ত ও পুনর্গঠন ছাড়া মুক্তি নেই

হংকং কর্তৃপক্ষ বলছে, এই দুর্ঘটনা দেশটির নগর পরিকল্পনা, অগ্নিনিরাপত্তা এবং নির্মাণ ব্যবস্থায় বড় ধরনের দুর্বলতা তুলে ধরেছে। এই ঘটনার পর ভবন নিরাপত্তা আইন আরও কঠোর করা হতে পারে।

চূড়ান্তভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে ও নিখোঁজদের উদ্ধার করতে প্রশাসন সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

MAH – 14011 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button