যুক্তরাজ্যের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (Vice-Chancellor) ও প্রধান নির্বাহী হিসেবে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ইতিহাস গড়তে চলেছেন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ওসামা এস এম খান। তিনি মর্যাদাপূর্ণ ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ওয়েলসের এই শীর্ষ পদে নিয়োগ পেয়েছেন। আগামী বছরের মে মাসে তিনি বর্তমান উপাচার্য বেন ক্যালভার্টের স্থলাভিষিক্ত হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। এই নিয়োগ বাংলাদেশের জন্য এক বিশাল গর্বের বিষয়, যা আন্তর্জাতিক উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে বাংলাদেশি মেধাবীদের সক্ষমতার প্রমাণ বহন করে।
অধ্যাপক ওসামা খান তাঁর কর্মজীবনে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে করপোরেট ফাইন্যান্স, গাণিতিক অর্থনীতি এবং বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বিশ্বের বিভিন্ন স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান ও একাডেমিক নেতৃত্বে কাজ করে এসেছেন। তিনি বর্তমানে অ্যাস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি ভাইস চ্যান্সেলর (একাডেমিক) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। উচ্চশিক্ষায় নেতৃত্ব, ডিজিটাল রূপান্তর, কারিকুলাম উদ্ভাবন ও শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতা উন্নয়নে তার সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে।
নিয়োগের ঘোষণা ও ওসামা খানের প্রতিক্রিয়া
ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ওয়েলস কর্তৃপক্ষ কবে এই ঘোষণা দিয়েছে এবং নতুন উপাচার্যের ব্যক্তিগত অনুভূতি কেমন।
ঘোষণার তারিখ: সাউথ ওয়েলস বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে গত মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) এই গুরুত্বপূর্ণ নিয়োগের ঘোষণা দেওয়া হয়।
দায়িত্ব গ্রহণের সময়: অধ্যাপক ওসামা খান আগামী মে মাসে তার নতুন দায়িত্বভার বুঝে নেবেন।
প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে অর্জন: ওসামা এস এম খান প্রথম বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শিক্ষাবিদ, যিনি যুক্তরাজ্যের একটি সরকারি (পাবলিক) বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য ও প্রধান নির্বাহী (CEO) হিসেবে নিয়োগ পেলেন। এটি আন্তর্জাতিক শিক্ষা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক।
ওসামা খানের অনুভূতি: উপাচার্য হিসেবে মনোনীত হওয়ার পর প্রতিক্রিয়ায় অধ্যাপক খান এই অর্জনকে “অসাধারণ গৌরবের বিষয়” বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার নীতি এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক ইতিবাচক পরিবর্তনে তাদের ভূমিকা তাকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছে।
শিক্ষাজীবন: যশোর থেকে কেমব্রিজ
অধ্যাপক ওসামা খানের শিক্ষাজীবন, যা বাংলাদেশের যশোর থেকে শুরু হয়ে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বিস্তৃত।
পৈতৃক নিবাস ও শৈশব: অধ্যাপক খানের পৈতৃক নিবাস বাংলাদেশের যশোর জেলায়। তার বাবা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চাকরি করায় তিনি দেশের বিভিন্ন সেনানিবাসে বড় হয়েছেন।
দেশের শিক্ষা: বাংলাদেশে তিনি ঐতিহ্যবাহী কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজ এবং পরবর্তীতে ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (আইইউবি) থেকে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক (Business Administration) ডিগ্রি লাভ করেন।
যুক্তরাজ্যে উচ্চশিক্ষা: ২০০০ সালে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাজ্যে যান এবং বিশ্বের অন্যতম সেরা বিদ্যাপীঠ কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রিয়েল এস্টেট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইকোনমিকসে এমফিল ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি রিয়েল এস্টেট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট বিষয়ে গবেষণা করেছেন।
দীর্ঘ কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা
উপাচার্য পদে নিয়োগের আগে অধ্যাপক ওসামা খান কোথায় কোথায় একাডেমিক নেতৃত্ব দিয়েছেন।
বর্তমান পদ: ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ওয়েলসে যোগ দেওয়ার আগে তিনি অ্যাস্টন ইউনিভার্সিটির ডেপুটি ভাইস চ্যান্সেলর (একাডেমিক) হিসেবে সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
পূর্ববর্তী নেতৃত্ব: এর আগে তিনি ইউনিভার্সিটি অব সারে এবং সোলেন্ট ইউনিভার্সিটিতে প্রোভাইস চ্যান্সেলর (একাডেমিক) এবং ডিরেক্টর অব লার্নিং অ্যান্ড টিচিংয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ একাডেমিক নেতৃত্বের পদে কাজ করেছেন।
পেশাগত ক্ষেত্র: শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হওয়ার আগে তিনি মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকিং ও করপোরেট ফিন্যান্স খাতেও সাফল্যের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।
শিক্ষকতা ও প্রভাব: তার একাডেমিক জীবনে তিনি সরাসরি প্রায় ১৬ হাজার শিক্ষার্থীকে পড়িয়েছেন এবং পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছেন আরও অনেককে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও বোর্ডের প্রত্যাশা
ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ওয়েলসে অধ্যাপক খানের ভিশন কী এবং বোর্ড তাকে নিয়ে কী ভাবছে।
খান-এর ভিশন: নতুন উপাচার্য ওসামা খান জানিয়েছেন, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিলেমিশে একটি “আরও সাহসী ও উদ্ভাবনী ভবিষ্যৎ” গড়তে চান। তার লক্ষ্য হলো, অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার মাধ্যমে সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা।
বোর্ড চেয়ারম্যানের মন্তব্য: বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব গভর্নরসের চেয়ারম্যান রিচার্ড লয়েড-ওয়েন অধ্যাপক খানের নিয়োগকে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “অধ্যাপক খান মূল্যবোধনির্ভর ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন একজন নেতা।” তিনি তাঁর নেতৃত্বে একটি নতুন, উদ্ভাবনী ও রূপান্তরমুখী অধ্যায়ের সূচনা প্রত্যাশা করেন।
আমিনা তাবাসসুম (ওসামা খানের স্ত্রী): “এটি আমাদের পরিবারের জন্য অসাধারণ গৌরবের বিষয়। আমরা আশা করি, তিনি তাঁর নতুন দায়িত্বে সফল হবেন এবং বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করবেন।”
পারিবারিক জীবন ও বর্তমানে বসবাস
অধ্যাপক ওসামা খানের ব্যক্তিগত জীবন এবং তার পরিবার কোথায় বসবাস করছে।
বিবাহ ও সন্তান: অধ্যাপক খান ২০০২ সালে আমিনা তাবাসসুমের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের দুই সন্তান রয়েছে।
সন্তানদের পরিচিতি: তাদের ছেলে সম্প্রতি লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস (এলএসই) থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক সম্পন্ন করে বর্তমানে অ্যাসোসিয়েট কনসাল্ট্যান্ট হিসেবে কর্মরত। তাদের মেয়ে ইউনিভার্সিটি অব সারে–তে ক্রিমিনোলজি ও সাইকোলজি বিষয়ে পড়াশোনা করছে।
বর্তমান আবাস: অধ্যাপক ওসামা খান বর্তমানে স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে লন্ডনের উপকণ্ঠে সারে কাউন্টিতে বসবাস করেন।
বৈশ্বিক শিক্ষা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পদচিহ্ন
অধ্যাপক ওসামা এস এম খানের মতো একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শিক্ষাবিদের যুক্তরাজ্যের একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়া নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের জন্য এক বিশাল সম্মান ও অনুপ্রেরণার উৎস। এই অর্জন শুধু তার ব্যক্তিগত সাফল্য নয়, বরং এটি বিশ্বকে দেখায় যে, সঠিক সুযোগ পেলে বাংলাদেশি মেধাবীরা বৈশ্বিক শিক্ষাঙ্গনেও সর্বোচ্চ নেতৃত্ব দিতে সক্ষম। উচ্চশিক্ষায় তার সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতা এবং নেতৃত্বের গুণাবলী ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ওয়েলসকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এটি বাংলাদেশের শিক্ষা এবং মেধাবীদের বৈশ্বিক স্বীকৃতি বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
এম আর এম – ২৩৮৭,Signalbd.com



