বিতর্কিত বাউলশিল্পী আবুল সরকার মহারাজ ওরফে আবুল বয়াতি শুধু ধর্মীয় কটূক্তির জন্যই নয়, পারিবারিক ও সম্পত্তির বিরোধের কারণেও বর্তমানে সমালোচিত। তার আপন ছোট ভাই জাহাঙ্গীর আলমের অভিযোগ, আবুল বয়াতি তার অন্য ভাইবোনদের ঠকিয়ে বাবার মোট ৬১ শতাংশ সম্পত্তির মধ্যে একাই ৪৫ শতাংশ জমি গোপনে লিখে নিয়েছেন। শুধু তাই নয়, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তিনি ছোট ভাইকে হয়রানি করেছেন, মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে জেলে পাঠিয়েছেন এবং তার বাড়িতে থাকা একটি মহিলা মাদরাসাও বন্ধ করে দিয়েছেন।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মামলায় বর্তমানে কারাগারে থাকা এই বাউলশিল্পীর বিরুদ্ধে তার পরিবার থেকেই উঠেছে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং ভাইকে হয়রানির গুরুতর অভিযোগ। জাহাঙ্গীর আলম যিনি পেশায় একজন মসজিদের ইমাম, তিনি জানান, ধর্ম নিয়ে আবুল বয়াতির অপব্যাখ্যার কারণে তাদের মধ্যে সম্পর্ক ভালো ছিল না। এই বিরোধের জেরেই আবুল বয়াতি তার রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতাকে ব্যবহার করে আপন ভাইয়ের বিরুদ্ধে একের পর এক পদক্ষেপ নেন। সম্পত্তির দখল ও হয়রানির এই বিষয়টি এখন মানিকগঞ্জজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রে।
পৈতৃক সম্পত্তি দখলের অভিযোগ
আবুল বয়াতি কীভাবে তার ভাইবোনদের বঞ্চিত করে সম্পত্তির একটি বড় অংশ নিজের নামে লিখে নিয়েছিলেন।
মোট সম্পত্তির পরিমাণ: আবুল বয়াতির বাবার মোট সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ৬১ শতাংশ জমি।
দখলের অভিযোগ: তার ছোট ভাই জাহাঙ্গীর আলমের অভিযোগ, সাত ভাইবোনের মধ্যে আবুল বয়াতি অন্যদের ঠকিয়ে বাবার এই ৬১ শতাংশ সম্পত্তির মধ্যে একাই ৪৫ শতাংশ জায়গা গোপনে নিজের নামে লিখে নেন।
জাদুটোনা ও প্রতারণা: ছোট ভাই জাহাঙ্গীরের আরও অভিযোগ, আবুল বয়াতি বাবাকে ওষুধ খাইয়ে জাদুটোনা করে এই কাজটি করেছেন, যা সম্পত্তির অধিকার থেকে অন্যান্য ওয়ারিশদের বঞ্চিত করেছে।
চলমান মামলা: বর্তমানে আবুলের দখলকৃত জমি এবং ৪ শতাংশ জমি দখলের ঘটনা নিয়ে মামলা চলমান রয়েছে।
ভাইয়ের ওপর হয়রানি ও মাদরাসা বন্ধ
আবুল বয়াতি রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কীভাবে তার আপন ছোট ভাইকে হয়রানি করেছেন।
ইমাম ভাইয়ের সঙ্গে বিরোধ: আবুল বয়াতির ছোট ভাই জাহাঙ্গীর আলম একটি মসজিদের ইমাম। আবুল বয়াতির ধর্মীয় বিষয়ে অপব্যাখ্যা দেওয়ার কারণে দুই ভাইয়ের মধ্যে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ভালো ছিল না।
রাজনৈতিক প্রভাবের অপব্যবহার: আবুল বয়াতি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার সুযোগ নেন। এই রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তিনি আপন ভাইয়ের ওপর চড়াও হন।
মিথ্যা মামলা ও জেল: জাহাঙ্গীর আলম অভিযোগ করেন, আবুল বয়াতি তাকে ‘জামায়াত ও শিবিরের তকমা’ দিয়ে একাধিক মিথ্যা মামলায় জড়িয়েছেন এবং এর ফলে জাহাঙ্গীরকে জেলে যেতে হয়েছে।
মাদরাসা বন্ধ: জাহাঙ্গীর আলমের বাড়িতে একটি মহিলা মাদরাসা ছিল। আবুল বয়াতি তার রাজনৈতিক প্রভাব এবং প্রশাসনকে ব্যবহার করে সেই মাদরাসাটি বন্ধ করে দেন।
জমি দখলের অন্যান্য ঘটনা
পৈতৃক সম্পত্তি ছাড়াও আবুল বয়াতির বিরুদ্ধে জোরপূর্বক জমি দখলের আরও অভিযোগ।
৫ শতাংশ জমি দখল: এলাকাবাসীর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে আবুলের বাড়ির পাশেই ৫ শতাংশ জায়গায় একটি ঘর ছিল, যার মালিক ছিলেন ছোট ভাই জাহাঙ্গীর। আবুল বয়াতি তার ভক্তদের দিয়ে সেই ঘর ভেঙে পানিতে ফেলে দেন।
পুলিশ ও রাজনৈতিক উপস্থিতি: অভিযোগ রয়েছে, এই জমি দখলের সময় পুলিশের উপস্থিতি ছিল এবং প্রতিবাদ এড়াতে তিনি স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীকেও ঘটনাস্থলে উপস্থিত রেখেছিলেন।
অন্যান্য সম্পত্তি: পৈতৃক ভিটার বাইরেও আবুলের প্রায় ২০০ শতাংশ জমি কেনা আছে এবং নবীনগর এলাকায় তার একটি প্লটও আছে। এছাড়া মানিকগঞ্জের শিবালয়ে আরিচা-দৌলতদিয়া লঞ্চঘাটে লিজের জমিতে তিনি ‘আশা সুপার মার্কেট’ নির্মাণ করেছেন বলেও জানা যায়।
রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা ও ক্ষমতার উৎস
আবুল বয়াতি কীভাবে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বজায় রেখে প্রভাব খাটিয়েছেন।
ক্ষমতার কেন্দ্র: আবুল বয়াতির বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, তিনি তার বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী মন্ত্রীর (সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক) এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন।
চাটুকারি গান: অভিযোগ রয়েছে, তিনি আওয়ামী আমলে বিভিন্ন সময় গানের আসরে শেখ মুজিব, শেখ হাসিনাসহ মানিকগঞ্জের বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার নামে চাটুকারি গান পরিবেশন করে তাদের খুশি করার চেষ্টা করতেন, যা তার ক্ষমতা ধরে রাখার একটি কৌশল ছিল।
মামলার ভয়: এই রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতার কারণে স্থানীয় ধর্মপ্রাণ লোকজন তার ধর্মীয় কটূক্তি বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পেত না, কারণ তারা হয়রানি বা মামলার শিকার হওয়ার ভয় পেতেন।
ক্ষমতা ও দুর্নীতির যোগসূত্র
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ঘটনা কীভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং পারিবারিক দুর্নীতির একটি দৃষ্টান্ত।
- দুর্নীতির চরিত্র: পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে ভাইবোনদের ঠকানো এবং প্রভাব খাটিয়ে ছোট ভাইকে হয়রানি করা সামাজিক ও নৈতিক দুর্নীতির চরম রূপ। তার এই কার্যকলাপ একজন বিতর্কিত বাউলশিল্পীর অর্থ ও ক্ষমতার লোভের দিকটি তুলে ধরে।
- আইনের শাসন: রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে একজন মসজিদের ইমামের মতো ধর্মপ্রাণ মানুষকে মিথ্যা মামলায় জেলে পাঠানো এবং তার মাদরাসা বন্ধ করে দেওয়া আইনের শাসনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর সামিল।
- স্বচ্ছ তদন্তের দাবি: এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, ধর্মীয় কটূক্তির পাশাপাশি তার সম্পত্তি দখল ও হয়রানির অভিযোগগুলোও গুরুতর। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচিত, এই দুটি দিককে বিচ্ছিন্ন না রেখে একটি পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ তদন্ত করা।
আবুল বয়াতির ছোট ভাই জাহাঙ্গীর আলম : “আমার বাবাকে ওষুধ খাইয়ে জাদুটোনা করে ভাই একাই এত জমি গোপনে লিখে নিয়েছে। আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়েছে, আমার মাদরাসা বন্ধ করে দিয়েছে।”
নৈতিক স্খলনের পরিণতি
বিতর্কিত বাউলশিল্পী আবুল বয়াতির সম্পত্তি দখল, পারিবারিক হয়রানি এবং ধর্মীয় কটূক্তির মতো অপরাধগুলো তার নৈতিক স্খলনের চূড়ান্ত চিত্র তুলে ধরে। রাজনৈতিক প্রভাবকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে তিনি একদিকে যেমন নিজ পরিবারের সদস্যদের ঠকিয়েছেন, তেমনি ধর্মীয় ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছেন। বর্তমানে তিনি কারাগারে থাকলেও, তার বিরুদ্ধে সম্পত্তি দখল ও হয়রানির অভিযোগগুলোর দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক বিচার হওয়া প্রয়োজন। এই ঘটনা সমাজে এই বার্তা দেবে যে, ক্ষমতা বা রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা ব্যবহার করে ব্যক্তিগত অন্যায় ও দুর্নীতি করা হলে তার পরিণতি কঠোর হবে।
এম আর এম – ২৩৮৬,Signalbd.com



