প্রস্তাবনা: এক রাতের আগুনে সর্বস্ব হারানো মানুষের পাশে দাঁড়ালেন জামায়াত আমির
রাজধানী ঢাকার অন্যতম বৃহত্তম বস্তি কড়াইলে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় হাজারো মানুষ এক রাতে সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। ছিন্নভিন্ন জীবনের চরম এই সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। তিনি ঘটনাস্থলে গিয়ে শুধু আগুনে পুড়ে যাওয়া ঘর-বাড়ি দেখেননি, কথা বলেছেন বিপর্যস্ত মানুষদের সঙ্গে, শুনেছেন তাদের কান্না, কষ্ট ও উদ্বেগের কথা। এসময় তিনি জরুরি সহায়তা হিসেবে কম্বল ও খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করেন।
এই পরিদর্শন শুধু রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ছিল না, বরং মানবিকতার জায়গা থেকে দুর্যোগে আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতিও ছিল স্পষ্ট। ঘটনাটি আরও গভীরভাবে আলোচনায় আসে যখন তিনি সরকারের প্রতি আগুনের প্রকৃত কারণ উদঘাটন ও দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন নিশ্চিত করার আহ্বান জানান।
অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতা: মুহূর্তের আগুনে ধ্বংসস্তূপে পরিণত ঘরবাড়ি
মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) রাত সাড়ে ১১টার দিকে ডা. শফিকুর রহমান কড়াইল বস্তির ক্ষতিগ্রস্ত অংশে পৌঁছান। বস্তির সংকীর্ণ গলি, পুড়ে যাওয়া টিনের চালা, ভাঙা ঘর, ছাইয়ের স্তূপ আর কান্না—সব মিলিয়ে ঘটনাস্থলে তখনও তীব্র শোক ও আতঙ্কের পরিবেশ বিরাজ করছিল।
বস্তির বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন—
“আজকের আগুনে নিম্নআয়ের মানুষের বহু বছরের সঞ্চয়, জীবিকা, মাথা গোঁজার ঠাঁই—সবকিছু মুহূর্তে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। প্রাণহানি না হলেও এত মানুষের আশ্রয় হারানো অত্যন্ত হৃদয়বিদারক।”
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, আগুন এত দ্রুত ছড়িয়েছিল যে অনেকেই ঘর থেকে কোনো মালামাল বের করতে পারেননি। শিশু, বৃদ্ধ, নারী—সবার চোখে তখনও আতঙ্কের চিহ্ন স্পষ্ট ছিল।
ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য তাৎক্ষণিক সহায়তা
ডা. শফিকুর রহমান现场ে উপস্থিত হয়েই ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মধ্যে তাৎক্ষণিক মানবিক সহায়তা বিতরণ করেন। প্রতিটি পরিবারকে দুটি করে কম্বল ও খাদ্যসামগ্রী দেওয়া হয়।
তিনি বলেন—
“মানবিক দায়িত্ববোধ থেকেই আমরা এই সহায়তা নিয়ে এসেছি। বিপর্যস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।”
বস্তিবাসীরা জানান, সহায়তা পেয়ে তারা কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন, তবে মা-বাবা, শিশু, বৃদ্ধ সবাই এখন রাত কাটাচ্ছেন খোলা আকাশের নিচে। আগুনে ঘর হারা মানুষের খাবার, পরিচ্ছন্ন পানি, কাপড় ও আশ্রয়ের তীব্র সংকট রয়েছে।
বস্তিবাসীদের আর্তনাদ: ‘আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে’
পরিদর্শনের সময় ডা. শফিকুর রহমান অনেকের সঙ্গে কথা বলেন। একজন নারী শ্রমিক কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন—
“আমার ঘরটা ছাড়াও ছেলেমেয়েদের বই-খাতা, কাপড়, রাইস কুকার, সামান্য টাকা—সব পুড়ে গেল। এখন আমরা কোথায় যাব?”
আরেকজন রিকশাচালক জানান—
“দিন এনে দিন খাই, এখন ঘরটাই নেই। রাতে বাচ্চাদের কোথায় রাখব ভাবছি।”
বস্তিবাসীদের এসব কষ্টের কথা শুনে জামায়াত আমির গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
ডা. শফিকুর রহমানের বক্তব্য: সহায়তা ও তদন্ত দুটোই জরুরি
ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে তিনি বলেন—
১. সরকারের তাৎক্ষণিক সহায়তা জরুরি
তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, দুর্যোগ বা দুর্ঘটনার সময় রাষ্ট্রের প্রথম দায়িত্ব হলো ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো। তিনি বলেন—
“খাদ্য, পানি, চিকিৎসা, নিরাপদ আশ্রয় এবং দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসনের ব্যবস্থা – সবকিছু এখনই নিশ্চিত করা প্রয়োজন।”
২. অগ্নিকাণ্ডের কারণ উদঘাটন করা অপরিহার্য
তিনি উল্লেখ করেন—
“এত বড় বস্তিতে বারবার আগুন লাগছে। এর পেছনে কোনো নাশকতা বা ষড়যন্ত্র আছে কি না, সরকারকে খতিয়ে দেখতে হবে।”
৩. দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান
তিনি বলেন—
“অগ্নিকাণ্ডের প্রকৃত কারণ উদঘাটন করে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। জনগণ সত্য জানতে চায়।”
বস্তিবাসীদের জীবনযাপন ও ঝুঁকি: কেন বারবার আগুন?
কড়াইল বস্তি কয়েক দশক ধরে ঢাকা শহরের অন্যতম জনবহুল এলাকা। নিম্নআয়ের শ্রমজীবী মানুষ—গৃহকর্মী, রিকশাচালক, হকার, সিকিউরিটি গার্ড, কারখানা কর্মী—সবাই এখানে বসবাস করেন। তুলনামূলক কম ভাড়ায় থাকার সুযোগ থাকায় এই বস্তিতে মানুষের চাপও অনেক বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলেন—
- বস্তিতে গ্যাসলাইন ও বৈদ্যুতিক সংযোগের অনিয়ম,
- অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার অভাব,
- ঘনবসতি,
- সংকীর্ণ গলি,
- দ্রুত দাহ্য টিন-ঘর—
এসব কারণে আগুন একবার লাগলে তা ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
আগেও কড়াইল বস্তিতে একাধিকবার অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। এবারও একই প্রশ্ন উঠছে: আসলে এগুলো দুর্ঘটনা, নাকি আরো গভীর কোনো কারণ রয়েছে?
জরুরি পুনর্বাসন না হলে ভয়াবহ মানবিক সংকট
বস্তির বাসিন্দারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে খোলা জায়গায়, স্কুলে বা আশপাশের খোলা জায়গায় আশ্রয় নিচ্ছেন। শিশুদের শীত, খাবার, দুধ, ওষুধ—সবকিছুর অভাব তীব্র আকার ধারণ করেছে।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন—
“পুনর্বাসন ছাড়া শুধু ত্রাণ দিয়ে সমস্যার সমাধান হবে না। এই মানুষের একটি টেকসই বাসস্থানের ব্যবস্থা জরুরি।”
জামায়াত আমিরের প্রত্যাশা: সরকার, এনজিও ও সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে আসুক
ক্ষতিগ্রস্তদের দুর্ভোগ বিবেচনা করে তিনি বলেন—
“মানবিক বিপর্যয়ের এ মুহূর্তে সরকার, বেসরকারি সংস্থা এবং সমাজের সামর্থ্যবান সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এটি শুধু একটি রাজনৈতিক বিষয় নয়, এটি মানুষের জীবন ও ভবিষ্যতের প্রশ্ন।”
যারা ছিলেন সঙ্গে
পরিদর্শনের সময় উপস্থিত ছিলেন—
- ঢাকা মহানগরী উত্তর মেডিকেল থানা সভাপতি
- ঢাকা-১৭ আসনে জামায়াত মনোনীত সংসদ সদস্যপ্রার্থী ডা. এস এম খালিদুজ্জামান
- জামায়াত আমিরের পারসোনাল সেক্রেটারি নজরুল ইসলাম
- স্থানীয় নেতাকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকরা
তারা সবাই ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেন।
আগুনের ক্ষত মুছতে রাষ্ট্রীয় কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন
কড়াইল বস্তির ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড শুধু কয়েকশো ঘর পুড়ার ঘটনা নয়; এটি হাজারো নিম্নআয়ের মানুষের সম্পূর্ণ ভবিষ্যৎ, জীবনযাত্রা ও নিরাপত্তা নিয়ে গভীর সংকটের প্রতিচ্ছবি। যাদের শ্রমে ঢাকা শহর চলে, সেই মানুষেরাই আজ খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাচ্ছেন।
ডা. শফিকুর রহমানের এই পরিদর্শন এবং সহায়তা নিঃসন্দেহে মানবিক একটি উদ্যোগ। তবে দীর্ঘ মেয়াদে এই মানুষের জীবনযাত্রা স্থিতিশীল করতে হলে প্রয়োজন—
- সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ
- আগুনের কারণ চিহ্নিতকরণ
- দ্রুত পুনর্বাসন
- এবং নিরাপদ আবাসন নিশ্চিতকরণ
কড়াইল বস্তির এই ট্র্যাজেডি যেন আর কোনোদিন পুনরাবৃত্তি না হয়—এটাই প্রত্যাশা।
MAH – 14007 I Signalbd.com



