আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্তের উত্তেজনা নতুনভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আফগান সরকার সম্প্রতি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বিমান হামলার অভিযোগ তোলার পর পাকিস্তান তা সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরীফ চৌধুরী মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা আফগান জনগণের বিরুদ্ধে কোনো হামলা চালাইনি। আমাদের লক্ষ্য শুধুমাত্র সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযান। যদি কখনো এমন কিছু ঘটতো, ইসলামাবাদ তা স্বীকার করত।”
আফগানিস্তান-সহ সীমান্তবর্তী এলাকায় এই উত্তেজনা একটি দীর্ঘ ইতিহাসের ফল। কাবুলের সরকারি কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন যে, ইসলামাবাদের বিমান হামলায় খোস্তসহ একাধিক প্রদেশে কমপক্ষে ১০ জন নিহত হয়েছে, যার মধ্যে ৯ জন শিশু। এই অভিযোগে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক উত্তেজনা আরও বাড়ছে।
সীমান্তে চলমান উত্তেজনার পটভূমি
পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্ত এলাকা বরাবরই উত্তেজনাপূর্ণ। বিশেষ করে পাকিস্তানে নিষিদ্ধ ঘোষিত সশস্ত্র গোষ্ঠী টিটিপি (Tehrik-i-Taliban Pakistan, TTP) যে আশ্রয় নেয়, সেটি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বিবাদ দীর্ঘদিনের। আফগানিস্তানের কিছু প্রদেশে ত্রাণ এবং নিরাপত্তা শৃঙ্খলায় ব্যবধান থাকার কারণে এই অঞ্চলে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড বেড়েছে।
গত মাসে তালেবান যোদ্ধা এবং পাকিস্তানি সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষে উভয় দেশেই কয়েকশ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। সীমান্তবর্তী এলাকায় এই ধরনের হামলার অভিযোগ নতুন নয়। তবে এবার পরিস্থিতি শিশু ও নিরীহ সাধারণ মানুষের মৃত্যুতে কেন্দ্রিক হওয়ায় আন্তর্জাতিক নজরও তীব্রভাবে পড়েছে।
পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরীফ চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা আফগান জনগণের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের হুমকি বা আক্রমণ চালাইনি। আমাদের অভিযান সীমাবদ্ধ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে। কেবলমাত্র সেই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে হামলা চালানো হয় যারা পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের স্থায়ী শান্তি ও নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করে।”
চৌধুরী আরও বলেন, “তালেবান সরকারের পক্ষ থেকে যে অভিযোগ এসেছে, তা ভিত্তিহীন। ইসলামাবাদ কোনো হামলা করলে তা স্বীকার করবে। আমাদের লক্ষ্য সীমান্তবর্তী এলাকার শান্তি বজায় রাখা এবং সন্ত্রাসবাদের অবসান ঘটানো।”
আফগান সরকারের অভিযোগ
আফগান সরকারের মুখপাত্র বলেন, “খোস্ত প্রদেশসহ বিভিন্ন অঞ্চলে পাকিস্তানের বিমান হামলা চালানো হয়েছে। এই হামলায় কমপক্ষে ১০ জন নিহত হয়েছে, যার মধ্যে ৯ জন শিশু। এটি একটি নৃশংস ঘটনা এবং আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।”
আফগানিস্তানের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন, পাকিস্তানের সঙ্গে এই সীমান্ত বিবাদ রাজনৈতিক ও নিরাপত্তার জটিলতার প্রতিফলন। বিশেষত টিটিপির আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও মানবাধিকার দিক
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে, সীমান্তবর্তী এলাকায় সাধারণ মানুষের ওপর বিমান হামলা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা নিয়মিতভাবে সীমান্তবর্তী অঞ্চলের শিশু এবং নারীসহ নিরীহ নাগরিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে।
আফগানিস্তানের শিশুদের মৃত্যুর ঘটনা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগ বাড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সীমান্তে যুদ্ধবিরোধী পদক্ষেপ এবং শান্তিপূর্ণ সমঝোতা ছাড়া এমন ঘটনা এড়ানো সম্ভব নয়।
সীমান্ত নিরাপত্তা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
পাকিস্তান ও আফগানিস্তান উভয়ই সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার করতে কার্যক্রম শুরু করেছে। উভয় দেশের সেনাবাহিনী সীমান্ত পিলার এবং গোপন নজরদারি পোস্ট স্থাপন করছে। আফগান বিশ্লেষকরা মনে করেন, সীমান্তে নিয়মিত সমঝোতা ছাড়া দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধপ্রবণতা বাড়তে পারে।
আফগান সীমান্ত পুলিশ কর্মকর্তা জানান, “যদি সীমান্তে শান্তি প্রতিষ্ঠা না হয়, তবে শিশু, নারী এবং সাধারণ মানুষদের জীবন সর্বদা ঝুঁকির মধ্যে থাকবে। উভয় দেশের সরকারি সহযোগিতা ছাড়া সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়।”
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তে দ্বিপাক্ষিক সংঘাত নতুন নয়। ১৯৭৯ সালের আফগানিস্তানীয় যুদ্ধ থেকে শুরু করে ২০০১ সালের আফগানিস্তান অভিযান পর্যন্ত সীমান্তবর্তী এলাকায় শান্তি অস্থির ছিল। ২০০৭ সালে পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলে তালেবান এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে যুদ্ধে বহুজনের প্রাণহানি ঘটেছিল।
তালেবান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরও সীমান্তের নিরাপত্তা, সন্ত্রাসবাদ দমন এবং মানবাধিকার নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। বিশেষত পাকিস্তানে নিষিদ্ধ গোষ্ঠী টিটিপি আশ্রয় নেওয়ায় সীমান্তে উত্তেজনা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সমসাময়িক বিশ্লেষণ
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সীমান্তে সংঘর্ষ এড়ানোর একমাত্র উপায় হলো উভয় দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সমঝোতা এবং সীমান্ত নজরদারি বাড়ানো। পাকিস্তান ও আফগানিস্তান উভয়ই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। তবে, সাধারণ মানুষের ওপর প্রভাব কমাতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং শান্তিপূর্ণ সমাধান গুরুত্বপূর্ণ।
বিশেষত শিশুদের ওপর হামলার অভিযোগ আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণে পাকিস্তানের জন্য নেতিবাচক ইমেজ তৈরি করতে পারে। তাই শান্তি স্থাপনের প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত করা এখন অতি জরুরি।
MAH – 14002 I Signalbd.com



