বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বর্তমানে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, তত বাড়ছে রাজনৈতিক উত্তাপ, মিছিল–মিটিং, পাল্টা কার্যক্রম এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা। এরই মাঝে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন।
তিনি বলেন, “বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি সন্তোষজনক না হলেও তফসিল ঘোষণার পর পরিস্থিতি অনেকটাই ভালো হবে।”
তার মতে, নির্বাচন কমিশন (ইসি) এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোচ্চ প্রস্তুত রয়েছে, এবং ভোটের দিন জনগণ যাতে নিরাপদে নিবাচর্ন কেন্দ্রে যেতে পারে—সে জন্য জোরদার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বুধবার সকালে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনী প্রশিক্ষণ ও মহড়া পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।
আইনশৃঙ্খলা নিয়ে উদ্বেগ—কেন?
নির্বাচনের সময় দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর তৎপরতা বেড়ে যায়। মিছিল, সমাবেশ, প্রচারণা এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে অনেক সময় উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন জেলায় সংঘর্ষ, রাজনৈতিক সহিংসতা, দলীয় কর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা এবং পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া–পাল্টা ধাওয়ার মতো ঘটনা দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘটেছে।
এসব কারণে সাধারণ মানুষের মনে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে যে, নির্বাচনকালীন পরিস্থিতি কি শান্তিপূর্ণ থাকবে?
সেই প্রেক্ষাপটেই সিইসি বলেন—
“পরিস্থিতি পুরোপুরি সন্তোষজনক বলা যাবে না। তবে তফসিল ঘোষণার পর আমরা আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আরও সুসংগঠিত ভূমিকা নিতে পারব।”
তফসিল ঘোষণার পর কেন পরিস্থিতি ভালো হবে?
নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা হলে নির্বাচন কমিশন পুরো প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ হাতে নেয়। এ সময় প্রশাসন, পুলিশ, বিজিবি, র্যাব, আনসারসহ সব বাহিনী নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিস্থিতি ভালো হওয়ার কয়েকটি কারণ রয়েছে —
১. নির্বাচনকালীন প্রশাসন ইসির অধীনে আসে
তফসিল ঘোষণার পর মাঠ ব্যবস্থাপনা, সরকারি কর্মকর্তা, প্রশাসন, পুলিশ—সবাই নির্বাচনের কাজে নিয়োজিত হয়। ফলে রাজনৈতিক চাপ কমে।
২. আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ মোতায়েন
ইসি সাধারণত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে:
- অতিরিক্ত পুলিশ
- মোবাইল টিম
- র্যাব–অপারেশন
- বিজিবির টহল
- স্ট্রাইকিং ফোর্স
এসব মোতায়েন করা হয়।
৩. আচরণবিধি কার্যকর হয়
তফসিল ঘোষণার পর আচরণবিধি কার্যকর হয়। তখন কোনো দল খোলামেলা শক্তি প্রদর্শন, মহাসমাবেশ, উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়া, সরকারি সুবিধা ব্যবহার—এসব করতে পারে না।
৪. প্রার্থী ও সমর্থকদের উপর নিয়ন্ত্রণ বাড়ে
প্রার্থীদের গতিবিধি, সভা–সমাবেশ, প্রচারণা—সবকিছুর নিয়মকানুন নির্ধারিত থাকে।
এসব কারণে দেশজুড়ে এক ধরনের নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়, যা সামগ্রিক নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে স্থিতিশীল করে।
ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বিশেষ ব্যবস্থা
সিইসি নাসির উদ্দিন জানান, নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যেই ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্র চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়া শুরু করেছে। তিনি বলেন—
“যেসব এলাকায় সহিংসতার ইতিহাস রয়েছে, সেসব স্থানে আলাদা ব্যবস্থা থাকবে। প্রয়োজনে অধিকসংখ্যক বাহিনী মোতায়েন করা হবে।”
এই বিশেষ ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে —
- প্রতিটি কেন্দ্রের জন্য ভিন্ন নিরাপত্তা পরিকল্পনা
- সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন
- দ্রুত মোতায়েনযোগ্য রিজার্ভ ফোর্স
- বিজিবির বিশেষ টহল
- র্যাবের মোবাইল দল
- থানাভিত্তিক কন্ট্রোল রুম
- প্রয়োজন হলে সেনাবাহিনীকে সহায়তা বাহিনী হিসেবে প্রস্তুত রাখা
ইসি সূত্রের দাবি, এবার নির্বাচনে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিজিবির নির্বাচনী প্রস্তুতি কী?
বিজিবি দেশের সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনী হলেও জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনগুলোতে তারা গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা ভূমিকা পালন করে থাকে।
বিজিবির ভূমিকাগুলো হলো —
- সীমান্ত এলাকায় বিশেষ নিরাপত্তা
- অস্ত্র চোরাচালান ঠেকানো
- ভোটের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সহায়তা
- স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে দ্রুত কার্যক্রম
- ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় টহল
সিইসি বিজিবির মহড়া দেখে সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং বলেন—
“বিজিবি খুবই পেশাদারিত্বের সঙ্গে প্রস্তুতি নিচ্ছে। তারা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বজায় রাখতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।”
নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি—এক নজরে
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে নির্বাচনের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য—
১. ভোটকেন্দ্রের তালিকা হালনাগাদ
দেশে প্রায় ৪২ হাজার ভোটকেন্দ্রের অবস্থান, নিরাপত্তা এবং ঝুঁকি বিশ্লেষণ চলছে।
২. নির্বাচন সামগ্রী প্রস্তুত
অব্যবহৃত ব্যালট বাক্স, সিল, পেপার সিল, ব্যালট পেপার— সব উপকরণ প্রস্তুতির কাজ চলছে।
৩. প্রশিক্ষণ
- প্রিসাইডিং অফিসার
- সহকারী প্রিসাইডিং
- পোলিং অফিসার
সব কর্মকর্তার জন্য ব্যাপক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে।
৪. আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয় বৈঠক
ইসির নেতৃত্বে ইতোমধ্যে একাধিক সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
৫. আচরণবিধি আপডেট
নির্বাচনী আচরণবিধি আপডেট করা হয়েছে, যাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া তথ্য ছড়ানো রোধ করা যায়।
ভোটারদের নিরাপত্তা—ইসির অগ্রাধিকার
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের দাবি, জনগণের নিরাপত্তা এবং শান্তিপূর্ণ ভোটাধিকার নিশ্চিত করা তাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।
সিইসি বলেন—
“ভোটাররা যেন নিশ্চিন্তে কেন্দ্রে যেতে পারে, সেটাই হবে আমাদের প্রধান লক্ষ্য। কোনোভাবেই কেউ যেন ভোটাধিকার প্রয়োগে বাধা সৃষ্টি করতে না পারে।”
এজন্য ইসি যে ব্যবস্থা নেবে—
- প্রতিটি কেন্দ্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি
- নারীদের জন্য আলাদা নিরাপত্তা
- প্রতিবন্ধী ভোটারদের সহায়তা
- ভোটের দিন পর্যাপ্ত পরিবহন সুবিধা
- দ্রুত বিরোধ মীমাংসা টিম
- কেন্দ্রের আশপাশে সাদা পোশাকের গোয়েন্দা
অতীত নির্বাচনের অভিজ্ঞতা কী বলে?
বাংলাদেশের অতীত নির্বাচনে বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে—
- কিছু এলাকায় সংঘর্ষ
- কেন্দ্র দখলের চেষ্টা
- ব্যালট পেপার ছিনতাই
- ভোটার আতঙ্ক
- ফলাফলকে কেন্দ্র করে বিশৃঙ্খলা
তবে সাম্প্রতিক কিছু নির্বাচন তুলনামূলক শান্তিপূর্ণ হয়েছে।
২০২৪ ও ২০২৩ সালের কিছু স্থানীয় নির্বাচনে প্রযুক্তি ব্যবহার যেমন সিসিটিভি নজরদারি, মোবাইল টহল, দ্রুত উদ্ধারকারী বাহিনীর উপস্থিতির কারণে পরিস্থিতি বেশ নিয়ন্ত্রণে ছিল।
ইসি মনে করে—
“সঠিক ব্যবস্থাপনায় উত্তেজনা কমানো সম্ভব এবং জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা যায়।”
রাজনৈতিক দলের প্রতিক্রিয়া
যদিও সিইসি ইতিবাচক মন্তব্য করেছেন, রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে বিভিন্ন দল এখনও মাঠে সরব এবং অভিযোগ–বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে।
কিছু দল বলছে—
- প্রশাসন এখনও নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করছে না
- নির্বাচন কমিশন কঠিন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না
- সহিংসতার আশঙ্কা রয়ে গেছে
তবে সরকারি দল বলছে—
- নির্বাচন হবে শান্তিপূর্ণ
- জনগণ মুক্তভাবে ভোট দিতে পারবে
- বিরোধীরা অযথা উসকানিমূলক মন্তব্য করছে
নির্বাচনকে ঘিরে এই দ্বন্দ্বই মূলত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে জটিল করে তোলে।
বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ
নির্বাচন বিশ্লেষক, নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ এবং রাজনৈতিক গবেষকরা মনে করেন—
তফসিল ঘোষণার পর তিনটি বিষয় স্পষ্ট হয়
- নির্বাচন কমিশনের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ
- প্রশাসনের দায়বদ্ধতা
- রাজনৈতিক দলের আচরণ নিয়ন্ত্রণ
যার ফলে উত্তেজনা কমে আসে।
তারা আরও বলেন—
“যদি ইসি কঠোর অবস্থানে থাকে এবং বাহিনীকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়, তাহলে সহিংসতা কমে যাবে।”
সাধারণ মানুষের আশা–উদ্বেগ
বাংলাদেশের সাধারণ ভোটারদের মধ্যে এখন দুটি অনুভূতি কাজ করছে—
- একদিকে তারা শান্তিপূর্ণ নির্বাচন চান
- অন্যদিকে সহিংসতা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে
তারা চান—
- নিরাপদ ভোটকেন্দ্র
- নিরপেক্ষ প্রশাসন
- রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বশীল আচরণ
একজন ভোটার বলেন—
“আমরা ভোট দিতে চাই, কিন্তু নিরাপত্তা পেলে। নির্বাচন যেন যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত না হয়।”
সিইসির বার্তা: ভয় নয়, আস্থা রাখুন
জাতির প্রতি বার্তা দিয়ে সিইসি নাসির উদ্দিন বলেন—
“ভোটাররা কোনোভাবেই আতঙ্কিত হবেন না। নির্বাচন কমিশন দৃঢ়ভাবে দায়িত্ব পালন করবে। আমরা চাই সবার অংশগ্রহণে সুন্দর নির্বাচন হোক।”
তিনি আরও আশ্বাস দেন—
“জরুরি যে কোনো পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্রুত ব্যবস্থা নেবে।”
MAH – 13994 I Signalbd.com



