রাজনীতি

প্রশাসন নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য: জামায়াতের প্রার্থী শাহজাহান চৌধুরীকে শোকজ

Advertisement

আসন্ন সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সম্পর্কে বিতর্কিত ও শৃঙ্খলাবিরোধী মন্তব্য করায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনের মনোনীত প্রার্থী শাহজাহান চৌধুরীকে কারণ দর্শানোর নোটিশ (শোকজ) দিয়েছে দলটি। তাঁর এই বক্তব্যকে দলীয় গঠনতন্ত্র, আদর্শ এবং দায়িত্বশীল রাজনৈতিক আচরণের পরিপন্থী হিসেবে উল্লেখ করেছে জামায়াত।

সোমবার (২৪ নভেম্বর) জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ারের সই করা এই নোটিশে শাহজাহান চৌধুরীকে আগামী সাত দিনের মধ্যে লিখিত জবাব দিতে বলা হয়েছে। জামায়াতের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই বক্তব্যের কারণে প্রশাসন, কূটনৈতিক মহল এবং দলের অভ্যন্তরেও তীব্র নিন্দা ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে, যা সংগঠনের ভাবমর্যাদা গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।

বিতর্কিত মন্তব্যের বিস্তারিত

শাহজাহান চৌধুরী ঠিক কী ধরনের মন্তব্য করেছিলেন, যা নিয়ে এত বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।

সম্মেলনের স্থান ও তারিখ: গত শনিবার (২২ নভেম্বর) সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি কনভেনশন হলে অনুষ্ঠিত ‘নির্বাচনী দায়িত্বশীল সম্মেলন’-এ শাহজাহান চৌধুরী এই বিতর্কিত বক্তব্য দেন।

মন্তব্যের উদ্ধৃতি: নোটিশে তাঁর বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে: “নির্বাচন শুধু জনগণ দিয়ে নয় যার যার নির্বাচনী এলাকায় প্রশাসনের যারা আছে, তাদের সবাইকে আমাদের আন্ডারে নিয়ে আসতে হবে। আমাদের কথায় উঠবে, আমাদের কথায় বসবে, আমাদের কথায় গ্রেফতার করবে, আমাদের কথায় মামলা করবে।”

মূল অভিযোগ: জামায়াত মনে করে, এই বক্তব্য রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের পেশাদারিত্ব, নিরপেক্ষতা ও মূল স্পিডকে স্পষ্টভাবে ব্যাহত করেছে এবং নির্বাচনে দলীয় হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত দিয়েছে।

জামায়াত সংগঠনের অবস্থান ও প্রতিক্রিয়া

দলীয় একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যের এই ধরনের বক্তব্যের পর জামায়াতে ইসলামী দ্রুত নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে।

পেশাদারিত্বের উপর জোর: জামায়াতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, সংগঠন মনে করে প্রশাসন পূর্ণ পেশাদারিত্বের সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন করবে এবং সেখানে কোনো দলীয় হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই

ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন: নোটিশে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয় যে, শাহজাহান চৌধুরীর এই বক্তব্য বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হওয়ার ফলে সংগঠনের ভাবমর্যাদা গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

শৃঙ্খলা পরিপন্থী: এই বক্তব্যকে দলীয় গঠনতন্ত্র, নীতি, আদর্শ, শৃঙ্খলা এবং দায়িত্বশীল রাজনৈতিক আচরণের পরিপন্থী বলে অভিহিত করা হয়েছে।

প্রশাসন ও কূটনৈতিক মহলের প্রতিক্রিয়া

জামায়াত নেতার মন্তব্যের পর দেশীয় প্রশাসন এবং আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহল থেকেও তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে।

প্রশাসনের উদ্বেগ: নোটিশে উল্লেখ করা হয়, এই বক্তব্য প্রকাশের পর প্রশাসনের বিভিন্ন স্তর থেকে তীব্র নিন্দা ও উদ্বেগের প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাচ্ছে। পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক সংস্থা এই মন্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছে।

কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া: সবচেয়ে গুরুতর বিষয় হলো, দেশের কূটনৈতিক মহল থেকেও সরাসরি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে। কূটনীতিকরা দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় প্রশাসনের নিরপেক্ষতা বজায় রাখার গুরুত্ব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

জনমনে বিরূপ প্রভাব: শুধু প্রশাসন বা কূটনৈতিক মহল নয়, দেশ-বিদেশে সংগঠনের জনশক্তি এবং সাধারণ জনগণের মাঝেও এই মন্তব্য বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।

শাহজাহান চৌধুরীর পূর্ববর্তী সতর্কতা

জামায়াত শাহজাহান চৌধুরীর বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ এবারই প্রথম আনেনি। এর আগেও তিনি এমন কাজ করেছেন বলে নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে।

শৃঙ্খলাবিরোধী বক্তব্য: নোটিশে বলা হয়েছে, ইতিপূর্বে বিভিন্ন সময়ে শাহজাহান চৌধুরী এই ধরনের সাংগঠনিক ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্নকারী ও শৃঙ্খলাবিরোধী বক্তব্য রেখেছেন।

পূর্ব সতর্কতা: তাঁর এই ধরনের আচরণের জন্য তাঁকে কয়েকবার সতর্ক করা হয়েছে এবং পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এমনকি আমীরে জামায়াতও তাঁকে ডেকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন এবং সতর্ক করেছেন।

পরিবর্তনের অভাব: এতদসত্ত্বেও তাঁর মধ্যে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না বলে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব হতাশা প্রকাশ করেছে।

শোকজ নোটিশের উদ্দেশ্য ও পরবর্তী পদক্ষেপ

আমীরে জামায়াতের নির্দেশে দেওয়া এই শোকজ নোটিশের মূল লক্ষ্য হলো শাহজাহান চৌধুরীর কাছ থেকে লিখিত কৈফিয়ত নেওয়া।

কারণ দর্শানোর নির্দেশ: শোকজ নোটিশে শাহজাহান চৌধুরীর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে, “কেন তাঁর ব্যাপারে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না”। এর মাধ্যমে দল তাঁকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়েছে।

সময়সীমা: লিখিত জবাব দেওয়ার জন্য তাঁকে ৭ (সাত) দিন সময় দেওয়া হয়েছে।

চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত: নোটিশে স্পষ্ট জানানো হয়, উল্লিখিত সময়ের মধ্যে সন্তোষজনক জবাব পাওয়া না গেলে দলীয় গঠনতন্ত্র ও শৃঙ্খলাবিধি অনুযায়ী পরবর্তী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। এর ফলে তাঁর মনোনয়ন বাতিল হওয়া বা দল থেকে বহিষ্কার হওয়ার মতো কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থারও ইঙ্গিত রয়েছে।

জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার (কোট): “এই বক্তব্যের কারণে ইতোমধ্যে সংগঠনের ভাবমর্যাদা গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটিকে দলীয় গঠনতন্ত্র, নীতি, আদর্শ, শৃঙ্খলা ও দায়িত্বশীল রাজনৈতিক আচরণের পরিপন্থী।”

নির্বাচনের মুখে জামায়াতের কঠোর বার্তা

আসন্ন নির্বাচনের আগে জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরীর বিরুদ্ধে দলের এই কঠোর অবস্থান একটি তাৎপর্যপূর্ণ বার্তা বহন করে।

নির্বাচনী কৌশল: জামায়াতের এই পদক্ষেপ প্রমাণ করে যে, তারা একটি গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ বজায় রাখার বিষয়ে সতর্ক। প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা বা পক্ষপাতমূলক আচরণের ইঙ্গিত দেওয়া থেকে দলীয় নেতাদের বিরত রাখতেই এই কঠোরতা।

ভাবমূর্তি রক্ষা: জামায়াত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নিজেদের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে। এমন বিতর্কিত মন্তব্য দলের সেই প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে বলেই কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে।

প্রশাসনিক আস্থাহীনতা: শাহজাহান চৌধুরীর মন্তব্যটি মূলত প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনগণের মধ্যে আস্থাহীনতা সৃষ্টি করতে পারত। সেই আশঙ্কা দূর করতে জামায়াত নিজের দলের নেতার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নিল।

শৃঙ্খলাই শেষ কথা

জামায়াতে ইসলামীর মনোনীত প্রার্থী শাহজাহান চৌধুরীকে প্রশাসন নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য শোকজ নোটিশ প্রদান প্রমাণ করে যে, একটি সুশৃঙ্খল রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াত গঠনতন্ত্র ও নিয়মানুবর্তিতাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রশাসনের পেশাদারিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা একটি জাতীয় নির্বাচনের আগে অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়। শাহজাহান চৌধুরীর জবাবের ওপরই নির্ভর করছে তাঁর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এবং জামায়াতের পক্ষ থেকে আগামী দিনে কেমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে নির্বাচনের আগে একজন প্রার্থীর বিরুদ্ধে এমন ব্যবস্থা গ্রহণ দেশের রাজনীতিতে এক বিশেষ বার্তা দিয়েছে।

এম আর এম – ২৩৭৭,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button