চিরবৈরী দুই প্রতিবেশী উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার মাঝে ভয়াবহ এক উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সিউলের সঙ্গে সব ধরনের সামরিক ও রাজনৈতিক যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে পিয়ংইয়ং, যার ফলে কোরীয় উপদ্বীপে যেকোনো মুহূর্তে সশস্ত্র সংঘর্ষের আশঙ্কা করছে দক্ষিণ কোরিয়া। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট লি জে মিয়ং এই পরিস্থিতিকে ‘অত্যন্ত বিপজ্জনক’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। উত্তর কোরিয়ার আগ্রাসী প্রস্তুতি এবং সামরিক আলোচনায় তাদের নীরবতা উত্তেজনাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
স্থানীয় সময় সোমবার (২৪ নভেম্বর) জি-২০ সম্মেলন শেষে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে তুরস্কগামী বিমানে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট লি জে মিয়ং এই উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, সীমান্ত বরাবর উত্তর কোরিয়ার নতুন করে তিন স্তরের কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ এবং টহল জোরদার করার পদক্ষেপ পরিস্থিতিকে আরও গুরুতর করে তুলেছে। প্রেসিডেন্ট লির মতে, ১৯৫৩ সালের যুদ্ধবিরতি চুক্তির পর এমন আগ্রাসী প্রস্তুতি আর দেখা যায়নি।
প্রেসিডেন্ট লির উদ্বেগ ও পরিস্থিতি বিশ্লেষণ
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট লি জে মিয়ং আন্তঃকোরীয় সম্পর্ককে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় দেখছেন।
যোগাযোগের অনুপস্থিতি: প্রেসিডেন্ট লি জানান, সিউলের পক্ষ থেকে বারবার যোগাযোগের আহ্বান জানানো হলেও উত্তর কোরিয়া তাতে সাড়া দিচ্ছে না। এই যোগাযোগের অভাব ন্যূনতম আস্থার ভিত্তিও নষ্ট করে দিয়েছে।
বিপজ্জনক পরিস্থিতি: ইয়োনহাপের প্রতিবেদন অনুযায়ী, লি উল্লেখ করেছেন যে, আন্তঃকোরীয় সম্পর্ক এখন অত্যন্ত শত্রুতাপূর্ণ ও মুখোমুখি অবস্থায় রয়েছে এবং যেকোনো সময় সংঘর্ষ শুরু হতে পারে। তিনি মনে করেন, ন্যূনতম আস্থার অভাবে উত্তর কোরিয়া কিছু ক্ষেত্রে অত্যন্ত বৈরী আচরণ প্রদর্শন করছে।
সামরিক পদক্ষেপ: উত্তর কোরিয়া সামরিক সীমান্তে নতুন করে কাঁটাতারের বেড়া ও সামরিক স্থাপনা নির্মাণ শুরু করেছে। তিন স্তরের কাঁটাতার নির্মাণ করে টহল জোরদার করাকে তিনি আগ্রাসী প্রস্তুতি হিসেবে দেখছেন।
সীমান্ত লঙ্ঘন ও সতর্কতামূলক গুলি
যোগাযোগ বন্ধ থাকা এবং উত্তরের আগ্রাসী মনোভাবের জেরে সীমান্তে একাধিকবার উত্তেজনাকর ঘটনা ঘটেছে।
সীমান্ত অতিক্রম: চলতি বছর উত্তর কোরিয়ার সৈন্যরা অন্তত দশবারের বেশি দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক বিভাজন রেখা (এমডিএল) অতিক্রমের ঘটনা ঘটিয়েছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিক্রিয়া: এই ধরনের সীমান্ত লঙ্ঘনের ঘটনায় কিছু ক্ষেত্রে নির্ধারিত নিয়ম অনুযায়ী দক্ষিণ কোরিয়ার সৈন্যরা সতর্কতামূলক গুলি চালিয়েছে। এই ধরনের সংঘর্ষ মুহূর্তের মধ্যে বড় যুদ্ধে রূপ নিতে পারে বলে লি জে মিয়ং আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
আলোচনার প্রস্তাবের নীরবতা: দক্ষিণ কোরিয়া গত ১৭ নভেম্বর উত্তর কোরিয়াকে সামরিক আলোচনা শুরুর বিষয়ে প্রস্তাব দিয়েছিল। সীমান্তে সশস্ত্র সংঘর্ষ ঠেকাতে সামরিক বিভাজন রেখা বরাবর স্পষ্ট সীমা নির্ধারণের বিষয়ে আলোচনার জন্য এই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু পিয়ংইয়ং কোনো সাড়া দেয়নি।
পূর্ববর্তী উত্তেজনা ও সামরিক মহড়া
উত্তর কোরিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়ার বিরোধ বহু বছরের পুরনো হলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উত্তেজনা বেড়েছে।
যুদ্ধবিরতির প্রেক্ষাপট: ১৯৫০-৫৩ সালের কোরীয় যুদ্ধের পর দুই দেশের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়েছিল, কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। ফলে কোরীয় উপদ্বীপ এখনো তাত্ত্বিকভাবে যুদ্ধের মধ্যে রয়েছে।
মার্কিন রণতরী: এর আগে দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন বিমানবাহী রণতরী মোতায়েনের ঘটনায় তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল উত্তর কোরিয়া। পিয়ংইয়ং এটিকে ‘আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ’ হিসেবে উল্লেখ করে পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি দিয়েছিল।
যৌথ সামরিক মহড়া: বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ২৮ হাজার ৫০০ সেনা অবস্থান করছে। যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার যৌথ সামরিক মহড়াকে দীর্ঘদিন ধরে উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক যুদ্ধের প্রস্তুতি বলে অভিযোগ করে আসছে।
দীর্ঘমেয়াদী শান্তি কাঠামো এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
প্রেসিডেন্ট লি জে মিয়ং উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে শান্তি অর্জনের পথকে দীর্ঘমেয়াদী প্রচেষ্টা হিসেবে দেখছেন।
দীর্ঘমেয়াদী প্রচেষ্টা: লি জে মিয়ং মনে করেন, দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা হবে। তবে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য পিয়ংইয়ংয়ের সঙ্গে সংলাপে বসা অত্যন্ত জরুরি।
মহড়া বন্ধের ইঙ্গিত: তিনি ইঙ্গিত দেন যে, যখন দুই দেশের মধ্যে একটি দৃঢ় স্থায়ী শান্তি কাঠামো গড়ে উঠবে, তখন দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ সামরিক মহড়া “বন্ধ করা ভালো” হবে। এই মন্তব্য উত্তর কোরিয়ার দাবির প্রতি একটি নরম সুরের ইঙ্গিত দেয়।
কূটনৈতিক প্রচেষ্টা: দক্ষিণ কোরিয়া আন্তর্জাতিক ফোরাম, যেমন জি-২০ সম্মেলন শেষে বিশ্বনেতাদের কাছে এই পরিস্থিতি তুলে ধরে কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করছে।
প্রেসিডেন্ট লি জে মিয়ং (কোট): “আন্তঃকোরীয় সম্পর্ক এখন অত্যন্ত শত্রুতাপূর্ণ ও মুখোমুখি অবস্থায় রয়েছে। ন্যূনতম আস্থার অভাবে উত্তর কোরিয়া কিছুক্ষেত্রে অত্যন্ত বৈরী আচরণ প্রদর্শন করছে।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মূল্যায়ন
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, উত্তর কোরিয়ার এই পদক্ষেপগুলো কেবল সামরিক প্রস্তুতি নয়, বরং আলোচনার টেবিলে সুবিধা আদায়ের কৌশলও হতে পারে।
কিম জং উনের কৌশল: উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন প্রায়শই এই ধরনের উচ্চমাত্রার সামরিক উত্তেজনা সৃষ্টি করে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করার এবং নিষেধাজ্ঞা শিথিলের জন্য দর কষাকষির চেষ্টা করেন।
আন্তর্জাতিক চাপ: বর্তমানে বিশ্বজুড়ে অন্যান্য সংঘাতের কারণে কোরীয় উপদ্বীপের পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মনোযোগ কম। উত্তেজনা বাড়িয়ে উত্তর কোরিয়া সেই মনোযোগ ফিরে পেতে চাইছে।
ভুল বোঝাবুঝির ঝুঁকি: যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকা অবস্থায় সীমান্তে ছোটখাটো কোনো ঘটনাও ভুল বোঝাবুঝির কারণে বড় সংঘাতের জন্ম দিতে পারে। এই কারণেই উভয় পক্ষের সামরিক হটলাইনগুলো চালু রাখা অত্যন্ত জরুরি ছিল।
উপসংহার: কোরীয় উপদ্বীপে অস্থিরতা
দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার সব যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া এবং সীমান্তে আগ্রাসী সামরিক প্রস্তুতি কোরীয় উপদ্বীপে এক নতুন অস্থিরতা তৈরি করেছে। প্রেসিডেন্ট লি জে মিয়ংয়ের “যেকোনো মুহূর্তে সংঘাত” এর আশঙ্কা এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় হুমকি। ১৯৫৩ সালের যুদ্ধবিরতির পর এমন বিপজ্জনক পরিস্থিতি দেখা যায়নি বলে তাঁর মন্তব্য পরিস্থিতিটির গুরুত্ব তুলে ধরে। এই সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো সংলাপ এবং উত্তর কোরিয়াকে অবশ্যই দক্ষিণ কোরিয়ার আলোচনার আহ্বানে সাড়া দিতে হবে। অন্যথায়, এই সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি কেবল আঞ্চলিক নয়, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্যও মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে।
এম আর এম – ২৩৭৪,Signalbd.com



