বাংলাদেশ

কড়াইল বস্তিতে ভয়াবহ আগুন: ফায়ার সার্ভিসের ১১ ইউনিট ঘটনাস্থলে

Advertisement

রাজধানীর সবচেয়ে বড় ও ঘনবসতিপূর্ণ বস্তিগুলোর একটি কড়াইল বস্তিতে মঙ্গলবার বিকেলে ভয়াবহ আগুন লাগে। হঠাৎ করে ধোঁয়া ও আগুনের লেলিহান শিখা দেখা দিলে মুহূর্তেই বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আগুনের খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১১টি ইউনিট ঘটনাস্থলের উদ্দেশ্যে দ্রুত রওনা হয়েছে এবং আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে কাজ করছে।

আগুন লাগে বিকেল ৫টা ২২ মিনিটে

ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, মঙ্গলবার ২৫ নভেম্বর বিকেল ৫টা ২২ মিনিটে আগুন লাগার সংবাদ পায় তারা। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই টঙ্গি, খিলগাঁও, বারিধারা, তেজগাঁওসহ নিকটস্থ স্টেশনগুলোর ইউনিট ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়।

ফায়ার সার্ভিসের ডিউটি অফিসার রাশেদ বিন খালিদ জানিয়েছেন, আগুন লাগার কারণ এখনো স্পষ্ট নয়। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, বস্তির ঘরগুলো টিন ও কাঠ দিয়ে নির্মিত হওয়ায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। এ ছাড়া গ্যাসের চুলা, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট অথবা রান্নার সময় অসতর্কতা থেকেও আগুনের সূত্রপাত হতে পারে।

তিনি আরও বলেন, “আমাদের ১১টি ইউনিট দ্রুত ঘটনাস্থলে যাচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চলছে। এখন পর্যন্ত হতাহতের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও এখনও নিশ্চিত নয়।”

কড়াইল বস্তি—ঝুঁকির আরেক নাম

কড়াইল বস্তি ঢাকার অন্যতম বৃহত্তম অবৈধ বসতি, যেখানে কয়েক লাখ মানুষ বসবাস করেন। অগ্নিকাণ্ড, স্বল্প অবকাঠামো, সংকীর্ণ গলি, পানির অপর্যাপ্ততা, পুরোনো বৈদ্যুতিক লাইন—সব মিলিয়ে প্রতি বছরই এই বস্তি বড় দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে থাকে।

বস্তির ঘরগুলো টিন-তাঁতের তৈরি, আগুন ছড়ায় দৌড়ের গতিতে

কড়াইল বস্তির ঘরগুলো সাধারণত টিন, কাঠ, প্লাস্টিক ও বিভিন্ন দাহ্য উপকরণ দিয়ে নির্মিত। তাই ছোট ধরণের আগুনও কয়েক মিনিটের মধ্যে ভয়ংকর আকার ধারণ করে। বস্তির ভেতরের সরু রাস্তা ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করে, ফলে আগুন নেভানোর কাজ আরও জটিল হয়ে ওঠে।

আগুন লাগার সম্ভাব্য কারণ

ফায়ার সার্ভিসের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী আগুনের সম্ভাব্য কারণ হতে পারে:

১. বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট

বস্তির ঘরগুলোতে তার জোড়া, পুরোনো বিদ্যুৎ সংযোগ ও অতিরিক্ত লোডের কারণে শর্টসার্কিট ঘটার প্রবণতা বেশি। অতীতে কড়াইল বস্তির বেশ কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের মূল কারণ ছিল বৈদ্যুতিক ত্রুটি।

২. রান্নার চুলা বা গ্যাসের লিকেজ

অনেক ঘরে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করা হয় যেগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত নয়। লিকেজ বা অসতর্কতার কারণে বড় বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।

৩. চুলায় রান্নার সময় অসতর্কতা

কড়াইল বস্তির অধিকাংশ পরিবারই কয়লা বা কাঠ ব্যবহার করে। তাই একটু অসাবধানতা থেকেও বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

সেখানে উপস্থিত মানুষের চোখে পরিস্থিতি

আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে এলাকাবাসী ছোট বালতি, মগ ও পানি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করতে থাকেন। মুহূর্তেই হাজারো মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। কেউ নিজেদের সন্তানকে বাঁচাতে ছুটছেন, কেউ হাতে গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র, কেউবা কেবল জরুরি পোশাক নিয়েই বের হতে সক্ষম হয়েছেন।

মহিলা ও শিশুরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। অনেকে জানান, চারদিকে শুধু ধোঁয়া আর দাউদাউ আগুন দেখা যাচ্ছিল। গলার পথে ধোঁয়া ঢুকে যাওয়ায় অনেকের শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল।

এক বাসিন্দা জানান, “আগুনের উৎস কোথায় তা বুঝতেই সময় লাগছিল। চোখের পলকে কয়েকটি ঘর পুড়ে গেল।”

ফায়ার সার্ভিসের চ্যালেঞ্জ

ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের মতে, কড়াইল বস্তিতে আগুন নেভানো সবসময়ই কঠিন। কারণ:

• রাস্তাগুলো সরু
• বড় গাড়ি বা পানির ট্যাংকার ঢুকতে পারে না
• পানি সংগ্রহের উৎস সীমিত
• মানুষজন আতঙ্কে দৌড়াদৌড়ি করায় অরাজকতা তৈরি হয়
• কাছাকাছি ঘরগুলোর দূরত্ব খুব কম হওয়ায় আগুন ছড়িয়ে যায় দ্রুত

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ফায়ার সার্ভিস বারবার কড়াইল বস্তিকে অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে উল্লেখ করে আসছে। কিন্তু বাসিন্দাদের আর্থিক সীমাবদ্ধতা ও শহরে বাসস্থানের সংকটের কারণে তারা এখানেই থাকতে বাধ্য হচ্ছেন।

অতীতেও ভয়াবহ আগুনের শিকার হয়েছে কড়াইল বস্তি

কড়াইল বস্তিতে প্রতি বছর গড়ে দুই থেকে তিনবার অগ্নিকাণ্ড ঘটে।
উল্লেখযোগ্য আগুনের ঘটনাগুলোর মধ্যে রয়েছে:

২০২১ সালের বড় অগ্নিকাণ্ড, যেখানে প্রায় এক হাজার ঘর পুড়ে যায়
২০১৭ সালের আগুন, যেখানে হাজারো মানুষ ঘর হারান
২০১৬ সালের ভয়াবহ আগুন, কয়েকশ ঘর ধ্বংস

এই সব ঘটনাতেই ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসী পুনরায় ঘরবাড়ি তৈরি করেছেন, আবার আগুন লেগে সব হারিয়েছেন—যা বস্তিবাসীর জীবনকে আরও অনিশ্চিত করে তুলেছে।

ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহতের তথ্য এখনো নিশ্চিত নয়

ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, এখন পর্যন্ত কেউ হতাহত হয়েছে এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে এলাকার ঘনবসতি ও দ্রুত ছড়িয়ে পড়া আগুনের কারণে অনেক পরিবার ঘর হারানোর শঙ্কায় আছেন।

দুর্ঘটনাস্থলের পরিবেশ দেখে ধারণা করা হচ্ছে—

• বহু ঘর পুড়ে যেতে পারে
• বিপুল সংখ্যক মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারেন
• মূল্যবান কাগজপত্র, শিক্ষার্থীদের বই-খাতা নষ্ট হতে পারে
• দরিদ্র পরিবারগুলো বড় ক্ষতির মুখে পড়বে

ফায়ার সার্ভিস আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা ও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে কাজ করছে।

দ্রুত উদ্ধারের পাশাপাশি মানবিক সহায়তার প্রয়োজন

কড়াইল বস্তির প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের পর হাজারো পরিবার কয়েকদিন খোলা আকাশের নিচে থাকে। পানি, খাবার, জামাকাপড়, ওষুধ—সবকিছুতেই দেখা দেয় ব্যাপক সংকট।
সামাজিক সংগঠন, সরকারি সংস্থা ও স্থানীয় প্রতিনিধিদের এগিয়ে এসে সহায়তা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা তাই প্রতি বারই দেখা যায়।

বস্তিবাসীর ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন

প্রতিবারই আগুনের পর নতুন করে উঠে আসে আবাসন সংস্কার, নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, বৈদ্যুতিক তারের মান উন্নয়ন, দাহ্য উপকরণের ব্যবহার কমানো—ইত্যাদি আলোচনা।
কিন্তু বাস্তবে পরিবর্তন খুব কমই ঘটে। ফলে একই চক্র বারবার পুনরাবৃত্তি হয়।

শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত কড়াইল বস্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা থাকলেও কোনো টেকসই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়নি।
যতদিন না ঝুঁকিপূর্ণ বসতিগুলো নিরাপদভাবে পুনর্বিন্যাস করা যায়, ততদিন অগ্নিকাণ্ডের মতো দুর্ঘটনা থামানো কঠিন বলে মনে করেন নগর উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা।

কড়াইল বস্তির সর্বশেষ অগ্নিকাণ্ড আবারও শহরের বস্তিবাসীর অসহায় বাস্তবতা তুলে ধরলো। ঠিক কী কারণে আগুন লাগল, কত ঘর পুড়ল, কোনো প্রাণহানি হলো কি না—এসব জানতে ফায়ার সার্ভিস উদ্ধার ও নিয়ন্ত্রণ কাজ শেষ হওয়ার পর বিস্তারিত তথ্য জানাবে।

SignalBD.com পরিস্থিতির আপডেট পাঠকদের জানাতে পরবর্তী প্রতিবেদনেও তথ্য সরবরাহ করবে।

MAH – 13989 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button