বানিজ্য

সিটিটিসির তিন কুকুর বিক্রি হলো ৬ লাখ ৩০ হাজারে

Advertisement

বাংলাদেশ পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম—সিটিটিসি ইউনিটের বিশেষ প্রশিক্ষিত তিনটি কুকুর ৬ লাখ ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। ঢাকার মিরপুর-১৪ পুলিশ লাইন্সে স্থাপিত কে-নাইন টিম সদর দপ্তরে একটি উন্মুক্ত নিলামের মাধ্যমে কোরি, স্যাম ও ফিন নামের কুকুর তিনটি নতুন মালিকদের হাতে তুলে দেওয়া হবে ২৭ নভেম্বর। দীর্ঘ আট বছর ধরে দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা এই কুকুরগুলোকে কার্যত অবসরে পাঠানো হয়েছে।

মঙ্গলবার দুপুরে অনুষ্ঠিত নিলামে অংশ নিতে আগ্রহী প্রত্যেক নিলামকারীকে এক হাজার টাকা জামানত হিসেবে জমা দিতে হয়। নিলাম প্রক্রিয়া শেষ হয় দুপুরের মধ্যেই। কে-নাইন স্কোয়াডের পুলিশ পরিদর্শক ফখরুল আলম জানিয়েছেন, নিলামটি আগে থেকেই ঘোষণা করা ছিল এবং বেশ কয়েকজন আগ্রহী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এতে অংশ নেন।

কোরির দামই সর্বোচ্চ কেন?

কোরি, স্যাম ও ফিন—এই তিনটির মধ্যে সবচেয়ে বেশি দাম পাওয়া কুকুরটি হলো কোরি। যুক্তরাজ্য থেকে আমদানি করা ল্যাব্রাডর জাতের এই স্ত্রী কুকুরটি বিক্রি হয়েছে ৫ লাখ ৬০ হাজার টাকায়। একজন সাধারণ ক্রেতা কোরিকে কিনেছেন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪০ হাজার টাকায় স্যাম এবং ৩০ হাজার টাকায় ফিনকে কিনেছে পারটেক্স গ্রুপ।

অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, কেন একটি কুকুরের দাম পাঁচ লাখ টাকার ওপরে হতে পারে? বিশেষজ্ঞদের মতে, এর প্রধান কারণ হচ্ছে—পুলিশের বিশেষ প্রশিক্ষণ, দীর্ঘ কর্মঅভিজ্ঞতা এবং বিদেশি জাতের উচ্চমূল্য।
ল্যাব্রাডর ও জার্মান শেফার্ড বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তা বাহিনীর কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় কাজের কুকুর। এসব কুকুরের বুদ্ধি, অনুসন্ধান ক্ষমতা, গন্ধ শনাক্ত করার দক্ষতা অত্যন্ত উন্নত। বিশেষত বিস্ফোরক, মাদকদ্রব্য ও বিপজ্জনক উপকরণ খুঁজে পেতে তাদের দক্ষতা অতুলনীয়।

আট বছরের সেবায় সিটিটিসির গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী

তিনটি কুকুরেরই বয়স আট বছর। কুকুরের গড় কর্মক্ষম সময় সাধারণত সাত থেকে আট বছর হয়ে থাকে। এর পর তাদের প্রতিক্রিয়া ধীর হতে থাকে, দৌড় ও অনুসন্ধান সক্ষমতা কিছুটা কমে যায়। তাই পুলিশ বাহিনীতে দীর্ঘদিন ধরে তারা বিশেষ অভিযান, তল্লাশি, টহল ও অনুসন্ধান কার্যক্রমে দায়িত্ব পালন করলেও এখন তাদের নিয়মিত কাজে রাখা সম্ভব নয়।

তাদের কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা অসাধারণ। সিটিটিসির তথ্য অনুযায়ী, কুকুরগুলো বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত ছিল দুটি কাজে—
১. বিস্ফোরক শনাক্তকরণ
২. বিপজ্জনক বস্তু বা মাদকদ্রব্য খুঁজে বের করা

বিশেষ অভিযান, গুরুত্বপূর্ণ সভা–সমাবেশ, আন্তর্জাতিক ইভেন্ট, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান এবং বইমেলার মতো জনসমাগমে তারা দায়িত্ব পালন করেছে। এ ছাড়া হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো টার্মিনালে তল্লাশি কাজেও এদের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

কারা এদের প্রশিক্ষণ দেয়?

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সিটিটিসি ইউনিটের অধীনে রয়েছে বিশেষায়িত কে-নাইন টিম। এখানে বিদেশ থেকে আনা কুকুরগুলোকে দীর্ঘমেয়াদি ট্রেনিং দেওয়া হয়।
ট্রেনিংয়ের মধ্যে রয়েছে—

  • বিস্ফোরক শনাক্তকরণ
  • গন্ধ বিশ্লেষণ
  • সন্দেহভাজন বস্তুর অবস্থান নির্ণয়
  • অনুসন্ধান অভিযান
  • নিয়মশৃঙ্খলা ও বাধ্যতা ট্রেনিং

এ ছাড়া কুকুরগুলোকে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, পুষ্টিকর খাদ্য, মনস্তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণ এবং দৈনিক ব্যায়াম করানো হয়। ফলে তাদের কর্মজীবন থাকে সুসংগঠিত ও ফলপ্রসূ।

নিলামে কেন বিক্রি করা হলো?

পুলিশের কর্মকর্তা সূত্র জানায়, প্রতি বছর সিটিটিসি ইউনিটে নতুন কুকুর যুক্ত করা হয়। বয়সজনিত কারণে যখন পুরোনো কুকুরগুলো আর স্বাভাবিক গতিতে দায়িত্ব পালন করতে পারে না, তখন তাদের অবসর দেওয়া হয়। অবসরপ্রাপ্ত কুকুরগুলোকে কখনো কখনো পুলিশ সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করা হয়, আবার কোনো কোনো সময় নিলামের মাধ্যমে সাধারণ নাগরিকদের কাছে বিক্রি করা হয়, যাতে তারা ভালোভাবে পোষা প্রাণী হিসেবে জীবন কাটাতে পারে।

এবারের নিলামও সেই নিয়মিত প্রক্রিয়ারই অংশ।

কুকুরগুলোর বর্তমান স্বাস্থ্যের অবস্থা

যদিও বয়স তাদের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে, তবুও কে-নাইন টিমের কর্মকর্তারা নিশ্চিত করেছেন যে কুকুরগুলোর স্বাস্থ্য মোটামুটি ভালো। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও উচ্চমানের খাবার দেওয়ায় তারা এখনো সুস্থ। তাদের আর কঠিন কাজের উপযোগিতা নেই, তবে পোষা প্রাণী হিসেবে তারা স্বাভাবিকভাবে জীবন কাটাতে পারবে।

নতুন মালিকদের কাছে হস্তান্তরের প্রস্তুতি

২৭ নভেম্বর কুকুরগুলো নতুন মালিকদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হবে। এ সময় কে-নাইন টিমের প্রশিক্ষকরা কুকুরগুলোর অভ্যাস, খাদ্যাভ্যাস, চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা এবং যত্ন নেওয়ার নিয়ম সম্পর্কে ক্রেতাদের বিস্তারিত জানাবেন।

পুলিশ কর্মকর্তাদের মতে, প্রশিক্ষিত কর্মী হিসেবে কুকুরগুলো মানুষের প্রতি খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ ও অনুগত। তাই নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে তেমন সময় লাগবে না।

বাংলাদেশে পুলিশ ক্যানাইন ইউনিটের ইতিহাস

বাংলাদেশে পুলিশ কুকুর ব্যবহারের ইতিহাস খুব দীর্ঘ নয়। তবে সাম্প্রতিক দশকে সন্ত্রাসবাদ দমন, বিস্ফোরক শনাক্তকরণ ও মাদকবিরোধী অভিযানে এদের ভূমিকা অসামান্যভাবে বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আধুনিক বিশ্বের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কে-নাইন ইউনিট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, জাপানসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে এই ইউনিট বহু বছর ধরে রয়েছে।

সিটিটিসি ইউনিটের প্রতিষ্ঠার পর বিস্ফোরক শনাক্তকরণে বাংলাদেশ পুলিশও বিশ্বমানের কুকুর ব্যবহারের ধারণাকে গুরুত্ব দেয়। বর্তমানে ইউনিটে বেশকিছু ল্যাব্রাডর এবং জার্মান শেফার্ড জাতের কুকুর রয়েছে, যাদের মধ্যে কেউ নতুন, কেউ পুরোনো অভিজ্ঞ সদস্য।

বইমেলা ও বড় ইভেন্টে কুকুরগুলোর দায়িত্ব

এই তিন কুকুরের কর্মজীবনের অন্যতম উল্লেখযোগ্য অধ্যায় হলো বইমেলার নিরাপত্তা।
প্রতিবছর অমর একুশে বইমেলায় পুলিশের বিশেষ নিরাপত্তা দায়িত্ব থাকে। মানুষের ভিড় বেশি হওয়ায় বিস্ফোরক বা সন্দেহজনক বস্তু খুঁজে বের করতে কুকুরদের দক্ষতা অত্যন্ত প্রয়োজন হয়।

তাছাড়া আন্তর্জাতিক ভিআইপি আগমন, রাষ্ট্রীয় দিবসের অনুষ্ঠান, গুরুত্বপূর্ণ সমাবেশ ও বড় কনসার্টেও তারা দায়িত্ব পালন করেছে।
এয়ারপোর্টে কার্গো চেকিংয়ের সময় ফিন, কোরি ও স্যাম তল্লাশির কাজে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে বলে জানান কর্মকর্তারা।

যুক্তরাজ্য থেকে কেন আনা হয় এই জাতের কুকুর?

যুক্তরাজ্যের ল্যাব্রাডর ও জার্মান শেফার্ড জাতের কুকুর বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য কর্মী কুকুর হিসেবে স্বীকৃত।
কারণ—

  • গন্ধ শনাক্ত করার ক্ষমতা অত্যন্ত উন্নত
  • শারীরিক শক্তি বেশি
  • দীর্ঘসময় পর্যন্ত মনোযোগ ধরে রাখতে পারে
  • বুদ্ধিমত্তা অত্যন্ত উচ্চ
  • সহজে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে

বাংলাদেশ পুলিশ সাধারণত যুক্তরাজ্য, জার্মানি ও নেদারল্যান্ডস থেকে এই জাতের কুকুর সংগ্রহ করে থাকে। একটি প্রশিক্ষিত কুকুরের বাজারমূল্য সাধারণত ৮ থেকে ১৫ লাখ টাকার মধ্যে। তাই নিলামে কোরির দাম ৫ লাখ ৬০ হাজার হওয়াকে অনেকেই যৌক্তিক বলে মনে করছেন।

পুলিশ কুকুর অবসরে গেলে কী হয়?

বেশিরভাগ দেশেই অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কুকুরকে স্নেহময় পরিবেশে নতুন মালিকের কাছে দেওয়া হয়।
মূল উদ্দেশ্য—

  • যাতে তারা জীবনের শেষ সময়টা শান্তিপূর্ণভাবে কাটাতে পারে
  • নিয়মিত যত্ন ও খাদ্যের মাধ্যমে সুস্থ থাকে
  • বন্ধু ও পোষা প্রাণী হিসেবে মানুষের সঙ্গে সময় কাটাতে পারে

সিটিটিসি ইউনিটের কর্মকর্তারাও মনে করেন, কুকুরগুলো দেশকে তাদের দায়িত্ব শেষ করে দিয়েছে। এখন প্রয়োজন পরিবারিক পরিবেশে নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ জীবন।

সাধারণ মানুষের মধ্যে কে-নাইন কুকুরের জনপ্রিয়তা

পুলিশ কুকুর নিলামের ঘোষণা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার জন্ম দেয়। অনেকেই জানান, পুলিশে কাজ করা কুকুর পোষার আগ্রহ তাদের ছিল।
অনেকে আবার বিস্ময় প্রকাশ করেছেন পাঁচ–ছয় লাখ টাকায় কুকুর কেনার ক্ষমতার প্রতি। তবুও কুকুর তিনটির মতো দক্ষ ও প্রশিক্ষিত কুকুর সাধারণ বাজারে পাওয়া যায় না বলেই নিলামে আগ্রহীরা অংশ নেয়।

আট বছর ধরে সিটিটিসির হয়ে কঠিন দায়িত্ব পালন করা কোরি, স্যাম ও ফিন এখন নতুন জীবনে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। তাদের কর্মজীবন শেষ হলেও স্মৃতি রয়ে যাবে দেশের গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা কার্যক্রমে।
যারা তাদের কিনেছেন, তারা শুধু একটি পোষ্যই পাননি—পেয়েছেন দেশের নিরাপত্তায় এক সময় দৃষ্টান্তমূলক ভূমিকা রাখা তিন নীরব বীরকে।

MAH – 13988 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button