রাইজিং স্টারস এশিয়া কাপের ফাইনালে রুদ্ধশ্বাস লড়াইয়ের পর বাংলাদেশে ফিরেছে বাংলাদেশ ‘এ’ দল। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে কেউ তেমনভাবে ভাবেনি যে, এই তরুণ দল পরপর দুই ম্যাচে সুপার ওভারের নাটকীয়তা উপহার দেবে। সেমিফাইনালে ভারতের বিপক্ষে দারুণ জয় এবং ফাইনালে পাকিস্তানের সঙ্গে শ্বাসরুদ্ধকর টাই—সব মিলিয়ে টুর্নামেন্টজুড়ে নজর কেড়েছে আকবর আলির দল।
দেশে ফিরে বিমানবন্দরে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে দলের অধিনায়ক আকবর আলি ফাইনালের সুপার ওভার নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন। তার ভাষায়, “সুপার ওভারে কোনো দলই অভ্যস্ত নয়। এটি এমন একটি পরিস্থিতি যা খুবই কম আসে। তাই হঠাৎ এমন মুহূর্তে সেরাটা বের করে আনা সবসময় সম্ভব হয় না।”
দুই ম্যাচে টানা দুই সুপার ওভার—বাংলাদেশ দলের বিরল অভিজ্ঞতা
ক্রিকেটে সুপার ওভার সাধারণত টি-টোয়েন্টিতেই বেশি দেখা যায়। তাও নিয়মিত নয়, বরং জরুরি অবস্থায় দুটি দল সমান রান করলে ম্যাচের ফল নির্ধারণে এটি ব্যবহার হয়। কিন্তু কোনো দল যদি পরপর দুই ম্যাচে সুপার ওভার খেলে—এটি সত্যিই বিরল ঘটনা।
বাংলাদেশ ‘এ’ দলের ক্ষেত্রে ঠিক তেমনটাই হলো।
সেমিফাইনালে ভারতের বিপক্ষে ১৯৪ রানের সমান স্কোর গড়ার পর বাংলাদেশ ম্যাচটি নিয়েছিল সুপার ওভারে। যেখানে রিপন মণ্ডলের দুর্দান্ত বোলিং ভারতের ব্যাটারদের রীতিমতো স্তম্ভিত করে দেয়। মাত্র দুই বলের মধ্যে তারা দুই উইকেট হারিয়ে শূন্য রানেই থেমে যায়। এরপর বাংলাদেশ মাত্র দুই বল খেলেই সহজে জয়ের বন্দরে পৌঁছে যায়।
এই জয় দলের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছিল। যুব বিশ্বকাপজয়ী দলপতি আকবর আলির নেতৃত্বে দলটি ফাইনালেও লড়াই করবে—এটা ছিল প্রত্যাশিত। কিন্তু ফাইনালের ম্যাচটি একেবারে ভিন্ন চিত্র দেখিয়েছিল।
ফাইনালে নাটকের নায়ক হলো লো–স্কোর ম্যাচ
ফাইনালে পাকিস্তানকে মাত্র ১২৫ রানে অলআউট করে বাংলাদেশ বুঝিয়ে দিয়েছিল, তাদের বোলিং এখন অনেক পরিণত। বিশেষ করে স্পিনাররা শুরু থেকেই চাপ ধরে রেখে পাকিস্তানি ব্যাটারদের বড় সংগ্রহ করতে দেয়নি। কিন্তু সহজ টার্গেট তাড়া করতে নেমেই যেন ভিন্ন এক বাংলাদেশকে দেখা গেল।
মাত্র ৫৩ রানে সাত উইকেট হারিয়ে যখন বাংলাদেশ ব্যাটিং বিপর্যয়ে পড়ে, তখন মনে হচ্ছিল ম্যাচটি আর কোনোভাবেই হাতে রাখা সম্ভব নয়। পাকিস্তানের বোলাররা আগ্রাসী লাইন–লেন্থে বাংলাদেশকে চেপে ধরেছিল। কিন্তু নিচের দিকের ব্যাটাররা ধীরে ধীরে ম্যাচে ফেরেন। ছোট ছোট জুটিতে প্রয়োজনীয় রান তুলতে থাকেন এবং শেষ পর্যন্ত ম্যাচটি টাই করে নিয়ে যান।
শেষ ব্যাটারদের সাহসিকতা বাংলাদেশের লড়াকু মনোভাবেরই পরিচয় দেয়। কিন্তু সমস্যা হলো—সুপার ওভার যে একেবারেই ভিন্ন খেলা।
সুপার ওভারের কঠিন বাস্তবতা: সামান্য ভুলেই খেলা বেরিয়ে যায় হাতে থেকে
ফাইনালের সুপার ওভারে ব্যাট করতে নেমে বাংলাদেশ মাত্র ৬ রান তোলে। তার আগেই তিন বলের মধ্যে দুই উইকেট হারায় তারা। মূলত হাই–রিস্ক শট খেলতে বাধ্য হওয়ার কারণেই এই ভুলগুলো হয়—এমনটাই মনে করেন আকবর আলি।
তিনি বলেন,
“সুপার ওভারে তো আর সাধারণ ক্রিকেটের নিয়ম চলে না। সেখানে আপনাকে শুরু থেকেই ঝুঁকি নিতে হয়। প্রতিটি বলেই আক্রমণাত্মক শট খেলতে হয়। অনেক সময় কাজ হয়, অনেক সময় হয় না। পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচটিতে আমাদের পরিকল্পনাটা ক্লিক করেনি।”
পাকিস্তান পরে মাত্র চার বলেই ৬ রানের টার্গেট পেরিয়ে যায় এবং চ্যাম্পিয়নের মুকুট পড়ে তাদের মাথায়।
সুপার ওভারের মনস্তত্ত্ব: ছোট রান তাড়া করা কঠিন কেন?
সুপার ওভারের মনস্তত্ত্ব ক্রিকেটে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সাধারণভাবে মনে হয়, ছোট লক্ষ্য তাড়া করা সহজ। কিন্তু বাস্তবে চাপ ঠিক উল্টোভাবেই কাজ করে। কারণ—
১. প্রতিটি বলেই রান তুলতে হবে
২. উইকেট হারানোর অবকাশ নেই
৩. ব্যাটাররা পুরো স্টেডিয়ামের চাপ নিজের উপর অনুভব করে
৪. বোলাররা সাধারণত ধীর গতির, ওয়াইড ইয়র্কার বা বাউন্সারের মাধ্যমে ব্যাটারকে বিভ্রান্ত করে
এই বাস্তবতা মাথায় রেখেই আকবর আলি মনে করেন, সুপার ওভারে অভিজ্ঞতার বড় অভাব রয়েছে বাংলাদেশের।
বাংলাদেশের তরুণদের জন্য বড় শিক্ষা
রাইজিং স্টারস এশিয়া কাপ মূলত ভবিষ্যতের ক্রিকেটারদের তৈরি করার একটি প্ল্যাটফর্ম। এখানকার ব্যর্থতা কিংবা হার–জিত ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষণীয়।
দলের কোচ, নির্বাচক এবং ক্রিকেট বিশ্লেষকেরা মনে করেন—
১. এ ধরনের চাপের ম্যাচ খেললে খেলোয়াড়রা ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মানিয়ে নিতে পারেন।
২. সুপার ওভার বা ডেথ ওভারের পরিস্থিতি সামলানোর দক্ষতা গড়ে উঠে।
৩. বিদেশের কন্ডিশনে খেলায় অভিজ্ঞতা বাড়ে।
৪. দলগত সহমর্মিতা ও পরিকল্পনায় উন্নতি আসে।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডও (বিসিবি) সাম্প্রতিক সময়ে ‘এ’ দলকে নিয়মিত সিরিজ দেওয়ার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। কারণ এখান থেকেই জাতীয় দলের জন্য খেলোয়াড় প্রস্তুত হয়।
আকবর আলির ভাষায় দলের ভবিষ্যৎ
যুব বিশ্বকাপ জয়ের পর থেকে আকবর আলি দেশের ক্রিকেটে এক বিশেষ জায়গায় রয়েছেন। যদিও সিনিয়র দলে এখনও নিয়মিত হতে পারেননি, তবে নেতৃত্বের দক্ষতা তাকে বারবার আলাদা করে তোলে।
তিনি বলেন,
“আমরা টুর্নামেন্টে ভালো ক্রিকেট খেলেছি। ফাইনাল জিততে পারলে আরও ভালো লাগত। তবে এখানে যে অভিজ্ঞতা হলো, সেটা আমাদের ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। বিশেষ করে সুপার ওভারের মতো কঠিন পরিস্থিতি সামলানো, রান তাড়া করার পরিকল্পনা তৈরির মতো বিষয়গুলো আরও উন্নত হবে।”
ক্রিকেট বিশ্লেষকদের মতামত: বাংলাদেশ আসলে কী শিখবে?
বাংলাদেশের প্রাক্তন ক্রিকেটার ও বিশ্লেষকরা মনে করেন—
১. টপ–অর্ডারের দায়িত্বশীলতা বাড়াতে হবে
ফাইনালের মতো ম্যাচে টপ–অর্ডার ব্যাটাররা ব্যর্থ হলে পুরো দল চাপের মধ্যে পড়ে।
২. পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যাটিং শেখা জরুরি
সহজ লক্ষ্য থাকলেও টুর্নামেন্টের ফাইনাল মানেই আলাদা চাপ। সেই চাপ সামলাতে দক্ষতা জরুরি।
৩. সুপার ওভার–বিশেষায়িত ভূমিকায় খেলোয়াড় প্রয়োজন
অনেক আন্তর্জাতিক দল এখন বিশেষভাবে সুপার ওভারের জন্য উদীয়মান ফিনিশার বা স্পেশালিস্ট বোলার তৈরি করছে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এমন পরিকল্পনা এলে ভবিষ্যতে বড় ফল আসতে পারে।
টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ ‘এ’ দলের সাফল্য
যদিও শিরোপা হাতছাড়া হয়েছে, তারপরও টুর্নামেন্টজুড়ে বাংলাদেশ তরুণ দলটি দেখিয়েছে দৃঢ়তা ও ধারাবাহিকতা।
- সেমিফাইনালে ভারতের মতো শক্তিশালী দলের বিপক্ষে দুর্দান্ত জয়
- বোলিং আক্রমণের ধারাবাহিক পারফরম্যান্স
- চাপের মুহূর্তেও লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা
- ফাইনালে লো–স্কোর ম্যাচে দারুণ প্রত্যাবর্তন
এসবই প্রমাণ করে যে দেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ ভালো হাতে রয়েছে।
সুপার ওভার বাংলাদেশের ঘুম কেড়ে নিলেও শেখার জায়গা অনেক
বাংলাদেশে ফেরার পর আকবর আলির মন্তব্য স্পষ্ট করে দেয়—
এই দলের অভিজ্ঞতা এখন আরও সমৃদ্ধ। পরপর দুই সুপার ওভার খেলায় তাদের মানসিক শক্তি বাড়বে, ভবিষ্যতের ম্যাচে এমন পরিস্থিতি সামলাতে অভিজ্ঞতা কাজে আসবে।
সুপার ওভার হোক বা ফাইনালে হার—ক্রিকেটে এগুলোই নতুন পথ দেখায়। আজকের ব্যর্থতা আগামী দিনের শক্তি হয়ে দাঁড়াবে—এটাই প্রত্যাশা।
বাংলাদেশ ‘এ’ দলের ক্রিকেটাররা হয়তো শিরোপা জিততে পারেননি, কিন্তু দেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে লড়াইয়ের মনোবল দিয়ে নতুন আশা জাগাতে পেরেছেন। রাইজিং স্টারস এশিয়া কাপ তাদের আন্তর্জাতিক মঞ্চে এক নতুন আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে, যা ভবিষ্যতের বড় সাফল্যের ভিত্তি হতে পারে।
MAH – 13986 I Signalbd.com



