ঢাকায় ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্পের সম্ভাব্য ঝুঁকি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। টাঙ্গাইলের মধুপুর ফাটলরেখায় এই মাত্রার ভূমিকম্প ঘটলে রাজধানীর প্রায় ৪০ শতাংশ ভবন ধসে পড়তে পারে। সমীক্ষার ভিত্তিতে রাজউক জানিয়েছে, এর ফলে দুই লাখের বেশি মানুষের প্রাণহানি হতে পারে।
রাজধানী ঢাকার জন্য এটি একটি বড় সতর্কবার্তা। সম্প্রতি, রাজধানীতে চার দফা ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার পরই এই সতর্কতা আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। রাজধানীর ভবনগুলোকে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুযায়ী নির্মাণ করা হয়েছে কি না তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি নগর পরিকল্পনার জন্য রাজউকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সমীক্ষা ও সেমিনারের তথ্য
সোমবার (২৪ নভেম্বর) রাজধানীর রমনায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ (আইইবি) ভবনে “ভূমিকম্পের ঝুঁকি হ্রাসে প্রস্তুতি ও করণীয়” শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এসময় রাজউকের পক্ষ থেকে বিস্তারিত সমীক্ষার তথ্য উপস্থাপন করা হয়।
সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন:
- শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান
- পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
- রাজউকের চেয়ারম্যান
- জরুরি সেবা প্রদানকারী সংস্থার প্রতিনিধি
- পেশাজীবী ও ভূমিকম্প ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞরা
সেমিনারে বিশেষভাবে আলোচিত হয় যে, রাজধানীর ভবনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে কি না এবং তা নিরীক্ষণ করার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া কতটা জরুরি।
ঝুঁকি মূল্যায়নের জরুরি আহ্বান
পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সেমিনারে বলেন, “ঢাকার ভবনগুলোর ঝুঁকি মূল্যায়নের কাজ দ্রুত শুরু করতে হবে। এই কাজে তৃতীয় পক্ষকে যুক্ত করা অত্যন্ত জরুরি। আমাদের আর সময় নষ্ট করার সুযোগ নেই।”
তিনি আরও বলেন, “যেখানে ভবন ভাঙার সম্ভাবনা রয়েছে, সেখানে কোনো ধরনের নমনীয়তা প্রদর্শন করা উচিত নয়। রাজউককে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া প্রয়োজন যাতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করা যায়। রাজউক এবং সিটি করপোরেশনকে এই ক্ষেত্রে কঠোর হতে হবে।”
রাজউকের পদক্ষেপ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান জানান, রাজধানীর ভবন নিরাপত্তা ও নগর পরিকল্পনা আরও কার্যকর করার জন্য “টাউন ইম্প্রুভমেন্ট অ্যাক্ট” সংশোধন করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে রাজউকের ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং ঝুঁকিপূর্ণ ভবন শনাক্ত ও নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে।
এছাড়াও, ভবিষ্যতে রাজউক এবং সিটি করপোরেশন যৌথভাবে প্রতিটি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করবে এবং জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
টাঙ্গাইলের মধুপুর ফাটল এবং ভূমিকম্পের ইতিহাস
বাংলাদেশে ভূমিকম্প সাধারণত টাঙ্গাইল, গাজীপুর ও ঢাকা জেলার মধুপুর ফাটলরেখা বরাবর বেশি প্রভাব ফেলে। ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেন, মধুপুর ফাটলরেখা বর্তমানে অচলাবস্থায় নেই এবং এটি বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকি বহন করছে।
বাংলাদেশ ভূমিকম্প সার্ভে ও আন্তর্জাতিক ভূমিকম্প সংস্থা জানিয়েছে, যদি ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্প ঘটে, ঢাকা শহরের প্রায় অর্ধেক পুরাতন এবং অবৈধ নির্মিত ভবন ধসে পড়তে পারে। এতে জনধন ও মানুষের জীবনযাত্রায় বিরূপ প্রভাব পড়বে।
ঢাকা শহরের ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ও নগর পরিকল্পনা
ঢাকার প্রায় ২০-২৫ শতাংশ ভবন পুরাতন এবং জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিক নগর পরিকল্পনা এবং ভবন নির্মাণ নিয়ন্ত্রণের অভাবে এই ঝুঁকি আরও বাড়ছে।
রাজউক এবং সিটি করপোরেশন একসাথে নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করছে যাতে পুরাতন ভবন পুনর্নির্মাণ বা সংস্কার করা যায়। বিশেষভাবে আশেপাশের এলাকায় বিপর্যয় মোকাবেলার জন্য জরুরি সেবা কেন্দ্রীকরণ করা হচ্ছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও প্রস্তুতি
ভূমিকম্পের সময় নিরাপদ আশ্রয়স্থল, জরুরি চিকিৎসা, খাদ্য ও পানীয় জোগান, এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা অপরিহার্য। সেমিনারে ভূমিকম্প ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞরা প্রস্তাব দেন:
- ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিতকরণ: বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে
- আপদা মোকাবেলা প্রশিক্ষণ: সাধারণ মানুষ এবং স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীদের জন্য
- জরুরি সেবা স্থাপন: মেডিকেল এবং ফায়ার সার্ভিস দ্রুত পৌঁছাতে পারবে এমন ব্যবস্থা
- কমিউনিটি সচেতনতা বৃদ্ধি: ভূমিকম্পের আগে, সময়ে এবং পরে করণীয় সম্পর্কে জনসাধারণকে শিক্ষিত করা
রাজউক এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সতর্কতা সত্ত্বেও, রাজধানীবাসীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো ব্যক্তিগতভাবে প্রস্তুতি নেওয়া। প্রতিটি পরিবারকে নিজস্ব জরুরি পরিকল্পনা তৈরি করা, ভূমিকম্পের সময় নিরাপদ স্থান নির্ধারণ করা এবং স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশ মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি।
ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ যা পূর্বাভাস দেয়া কঠিন। কিন্তু যথাযথ পরিকল্পনা ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে প্রাণহানি এবং ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব। রাজউকের সাম্প্রতিক সমীক্ষা এবং ত্বরিত পদক্ষেপের আহ্বান এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
MAH – 13976 I Signalbd.com



