বঙ্গোপসাগরে আগামী বুধবারের (২৬ নভেম্বর) মধ্যে একটি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় তৈরি হওয়ার আশঙ্কা করছে বাংলাদেশ ও ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগ। ইতোমধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপটি আরও ঘনীভূত হয়ে গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে। এই সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়ের নাম দেওয়া হয়েছে ‘সেনিয়ার’, যা সংযুক্ত আরব আমিরাত (UAE) দিয়েছে। আরবি শব্দটিতে ‘সিংহ’ বা সিংহের মতো প্রচণ্ড তাণ্ডবের ইঙ্গিত রয়েছে, যা আবহাওয়াবিদদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে।
আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, শনিবার তৈরি হওয়া এই সিস্টেমটি পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছে এবং এটি ক্রমাগত শক্তি সঞ্চয় করছে। পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপান্তরিত হতে পারে। বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হলে সেটি ডিসেম্বরের শুরুতে বাংলাদেশ বা ভারতের উপকূলের দিকে অগ্রসর হওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলের বাসিন্দাদের এখন থেকেই সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
নিম্নচাপ থেকে ঘূর্ণিঝড়ে রূপান্তরের গতিপথ
ঘূর্ণিঝড় ‘সেনিয়ার’-এর জন্ম প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে এবং এটি ক্রমশ শক্তি অর্জন করে চলেছে।
প্রাথমিক সৃষ্টি: গত শনিবার (২২ নভেম্বর) দক্ষিণ আন্দামান সাগরের কাছে যে নিম্নচাপটি তৈরি হয়েছিল, সেটি আরও ঘনীভূত হয়ে মালাক্কা প্রণালী এবং সংলগ্ন আন্দামান সাগরের ওপরে সুস্পষ্ট নিম্নচাপে পরিণত হয়।
গভীর নিম্নচাপে রূপান্তর: আবহাওয়ার পূর্বাভাস মডেল অনুযায়ী, আজ সোমবার (২৪ নভেম্বর) এটি আরও শক্তি সঞ্চয় করে দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগর এবং সংলগ্ন দক্ষিণ আন্দামান সাগরের উপরে গভীর নিম্নচাপে পরিণত হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস: আবহাওয়া বিভাগ জানিয়েছে, পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টায় এটি আরও পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম দিকে অগ্রসর হবে এবং বুধবার নাগাদ দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গোপসাগরের ওপরেই ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হতে পারে। সাগরে থাকার সময় এটির শক্তি বেশ বাড়তে পারে বলেও অনুমান করা হচ্ছে।
ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ ও ‘সেনিয়ারের’ অর্থ
ঘূর্ণিঝড়টির নাম এবং এর আভিধানিক অর্থ বিশেষ তাৎপর্য বহন করছে, যা এর সম্ভাব্য ভয়াবহতাকে নির্দেশ করে।
নামের উৎস: এই ঘূর্ণিঝড়টি সৃষ্টি হলে এর নাম হবে ‘সেনিয়ার’ (Senyar)। এই নামটি ঘূর্ণিঝড়ের নাম দেওয়ার জন্য গঠিত আঞ্চলিক কমিটি থেকে দিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত (UAE)।
তাণ্ডবের ইঙ্গিত: ‘সেনিয়ার’ শব্দের অর্থ হলো সিংহ। সাধারণত সিংহের শক্তি ও আগ্রাসী মনোভাবের সঙ্গে তুলনা করে এই নামটি দেওয়া হয়েছে। নামটির এই তাৎপর্যই আবহাওয়াবিদদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে যে, এটি একটি শক্তিশালী এবং বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে।
সম্ভাব্য অভিমুখ ও তীব্রতা নিয়ে অনিশ্চয়তা
ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টির পর এটি কোন দিকে অগ্রসর হবে এবং এর গতিবেগ কেমন হবে, সে বিষয়ে এখনই চূড়ান্ত ধারণা পাওয়া যায়নি।
পথের ভিন্নতা: ভারতীয় আবহাওয়া দফতর এবং কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেল ভিন্ন ভিন্ন পূর্বাভাস দিচ্ছে।
আঘাতের স্থান: বর্তমানে ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্য থেকে শুরু করে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম উপকূলের মধ্যবর্তী যেকোনো স্থানের উপর দিয়ে এটি স্থলভাগে আঘাত করার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তবে ঠিক কোন স্থানে এটি আঘাত করবে, সে বিষয়ে ২৬ বা ২৭ নভেম্বর আরও অধিক নিশ্চয়তা সহকারে জানা যাবে।
শক্তি বৃদ্ধির প্রবণতা: আবহাওয়াবিদদের মতে, বঙ্গোপসাগরে থাকার সময় এটি পর্যাপ্ত আর্দ্রতা ও উষ্ণতা পাবে, ফলে এর শক্তি বাড়তে পারে এবং এটি একটি অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে।
উপকূলে প্রভাবের পূর্বাভাস: বৃষ্টি ও সমুদ্রের সতর্কতা
সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বাংলাদেশের আবহাওয়া এবং উপকূলীয় এলাকায় পরিবর্তন আসতে শুরু করবে।
বৃষ্টির পূর্বাভাস: সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ডিসেম্বর মাসের ৩ তারিখ থেকে ৫ তারিখ পর্যন্ত বাংলাদেশের উপরে হালকা থেকে মাঝারি মানের বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই বৃষ্টি দেশের দক্ষিণ ও মধ্যাঞ্চলে বেশি হতে পারে।
শীতের বিলম্ব: নভেম্বরের শেষের দিকে এবং ডিসেম্বরের একেবারে শুরুর দিকে এই সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড় ও এর প্রভাবে বৃষ্টির কারণে ঠান্ডা কিছুটা কমবে। আবহাওয়াবিদরা মনে করছেন, ডিসেম্বরের ৪ কিংবা ৫ তারিখের আগে আবার শীত পড়ার সম্ভাবনা বেশ কম।
সমুদ্রের উত্তালতা: গবেষকরা সতর্ক করেছেন, ডিসেম্বর মাসের ১ তারিখের পর থেকে উত্তর বঙ্গোপসাগরের সমুদ্র উত্তাল হওয়ার আশঙ্কা করা যাচ্ছে। বিশেষ করে ঘূর্ণিঝড়টি উপকূলের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করলে জলোচ্ছ্বাসসহ সমুদ্রের উচ্চতা বাড়তে পারে।
কৃষক ও জেলেদের জন্য জরুরি পরামর্শ
ঘূর্ণিঝড় ও বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাসের কারণে উপকূলীয় এবং কৃষি-নির্ভর অঞ্চলের মানুষদের জন্য বিশেষ সতর্কতা ও পরামর্শ জারি করা হয়েছে।
কৃষকদের জন্য: জমিতে থাকা পাকা আমন ধান দ্রুত কেটে মাড়াই করা শেষ করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া শীতকালীন শাক-সবজি চাষিদের সম্ভাব্য এই বৃষ্টিপাতের কথা মাথায় রেখে বীজ বোনা ও জমিতে সেচ দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে বলা হয়েছে, যাতে বৃষ্টির কারণে বীজ নষ্ট না হয়।
জেলেদের জন্য: সমুদ্রগামী জেলেদের জন্য বিশেষ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। ১ ডিসেম্বরের মধ্যে উপকূলে ফেরার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রাখার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে সমুদ্রে মাছ ধরা সকল ট্রলারকে। ৩০ নভেম্বরের পরে নতুন করে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যেতে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
মোস্তফা কামাল পলাশ, আবহাওয়া ও জলবায়ুবিষয়ক গবেষক (কোট): “একটি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হতে যাচ্ছে এই বিষয়ে সকল আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেল একমত। সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়টি কেমন শক্তিশালী হবে ও কোন স্থানের উপর দিয়ে স্থলভাগে আঘাত করবে, তা ২৬ নভেম্বর অধিক নিশ্চয়তা সহকারে জানা যাবে।”
উপকূলের সতর্কতাই পারে দুর্যোগ কমাতে
বঙ্গোপসাগরে আগামী বুধবার নাগাদ ঘূর্ণিঝড় ‘সেনিয়ার’ তৈরি হওয়ার যে পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে, তা উপকূলীয় অঞ্চলে নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। ‘সিংহ’ অর্থ বহনকারী এই ঘূর্ণিঝড়টির নামেই এর সম্ভাব্য তাণ্ডবের আভাস স্পষ্ট। আবহাওয়ার পূর্বাভাস মডেলগুলো ঘূর্ণিঝড়টি তৈরি হওয়ার বিষয়ে একমত হলেও, এর চূড়ান্ত গতিপথ এবং আঘাতের তীব্রতা জানতে আরও কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হবে। এই পরিস্থিতিতে উপকূলীয় অঞ্চলের প্রশাসন, কৃষক এবং জেলেদের সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। পাশাপাশি দেশের আবহাওয়া দফতরকে নিয়মিতভাবে সর্বশেষ তথ্য সরবরাহ করতে হবে, যাতে যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় আগাম প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হয়। ঘূর্ণিঝড় ‘সেনিয়ার’-এর প্রতিটি পদক্ষেপের দিকে এখন সকলের নজর রয়েছে।
এম আর এম – ২৩৬২,Signalbd.com



