কৃষি

৭৩ কৃষি কর্মকর্তার পদ শূন্য, ভোগান্তিতে মাদারীপুরের কৃষকেরা

Advertisement

মাদারীপুর জেলার কৃষকরা দীর্ঘদিন ধরে নানা সমস্যায় ভুগছেন। জেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও পৌর এলাকায় পর্যাপ্ত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা না থাকায় কৃষকদের মাঠে মাঠে গিয়ে সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়েছে। ফলে কৃষকেরা সময়মতো সঠিক পরামর্শ পাচ্ছেন না, চাষাবাদে বাড়ছে ঝুঁকি, ব্যয় হচ্ছে বেশি, আর ফলন কমে যাচ্ছে—এমন অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন এলাকার কৃষকদের কাছ থেকে।

মাদারীপুরে মোট ৫৯টি ইউনিয়ন এবং ৪টি পৌরসভা রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি ইউনিয়নে তিনজন করে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা থাকার কথা। সে হিসেবে পুরো জেলায় ১৮১ জন কর্মকর্তা থাকা প্রয়োজন। কিন্তু বাস্তবে কর্মরত আছেন মাত্র ১০৮ জন। দীর্ঘদিন ধরে এখানে শূন্য পদে পড়ে আছে ৭৩টি আসন।

এই বিপুল ঘাটতি সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত করছে কৃষকদের। ফসলের মৌসুমে কিংবা রোগবালাইয়ের সময় কৃষকেরা যখন একজন কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মনে করেন, তখনই তাঁরা কাউকে খুঁজে পান না।

ইউনিয়নে কর্মকর্তা না থাকায় মাঠে নেই সঠিক দিকনির্দেশনা

মাদারীপুরের ঝাউদি ইউনিয়নের মাদ্রা গ্রামের কৃষক মো. জয়নাল জানান,
“আমরা যদি সব সময় কৃষি কর্মকর্তার দিকনির্দেশনা পেতাম, তাহলে আরও ভালোভাবে ফসল ফলাতে পারতাম। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই কাউকে পাওয়া যায় না। নিজের অভিজ্ঞতা দিয়েই চাষ করতে হয়।”

কৃষকের এ অভিযোগ কোনো ব্যতিক্রম নয়। জেলার প্রায় সব ইউনিয়নের কৃষকেরা একই অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন।

কালকিনি উপজেলার দক্ষিণ রমজানপুর গ্রামের কৃষক আয়ুব আলী বলেন,
“দু–তিন মাস পরপর আমাদের এলাকায় একজন কৃষি কর্মকর্তা আসেন। তখন কিছু পরামর্শ দেন ঠিকই, কিন্তু তাতে খুব একটা কাজ হয় না। কারণ, মাঠে প্রতিদিন কী সমস্যা হচ্ছে—সেটা কর্মকর্তারা জানেন না।”

সার-কীটনাশক ব্যবহারে ভুল হচ্ছে, ক্ষতি বাড়ছে

উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা না থাকার কারণে কৃষকেরা সারের সঠিক মাত্রা, সময়, কিংবা কোন কীটনাশক কখন ব্যবহার করতে হবে—এসব বিষয়ে যথাযথ পরামর্শ পাচ্ছেন না।

রাজৈর উপজেলার আমগ্রামের কৃষক কালাম মৃধা বলেন,
“নিজেদের অভিজ্ঞতা আর দোকানদারের কথার ওপর ভরসা করেই সার-কীটনাশক কিনে জমিতে দেই। কিন্তু অনেক সময় ভুল করি, ফসলের ক্ষতি হয়। একজন কর্মকর্তা যদি নিয়মিত পরামর্শ দিতেন, তাহলে উৎপাদন আরও বাড়ত।”

কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, ভুল সার বা কীটনাশক ব্যবহারের কারণে ফসলের ফলন ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। কখনো কখনো পুরো জমির ফলন নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এই ক্ষতি শুধু কৃষকের নয়, পুরো এলাকার খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থার ওপর প্রভাব ফেলে।

কৃষি সম্প্রসারণ সেবা সংকটে পুরো জেলার উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত

মাদারীপুর একটি কৃষিনির্ভর জেলা। জেলার বড় অংশের মানুষ চাষাবাদ, সবজি চাষ, ধান, পাট, ডাল–তিলসহ নানা ফসল উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল।

কিন্তু উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার সংকটের কারণে কৃষকদের মাঝে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ সীমিত হয়ে পড়েছে।

বিশেষত—

  • নতুন জাতের ধান বা সবজি
  • আধুনিক সেচ ব্যবস্থাপনা
  • রোগবালাই নিয়ন্ত্রণ
  • জৈব সার ব্যবহার
  • নিরাপদ সবজি উৎপাদন প্রযুক্তি

এসব বিষয়ে মাঠপর্যায়ে প্রশিক্ষণ ও তদারকি কমে যাওয়ায় কৃষকেরা পুরোনো পদ্ধতিতে কৃষিকাজ চালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে, কৃষিজমির সঠিক ব্যবহারও ব্যাহত হচ্ছে।

নতুন কৃষিপ্রযুক্তি গ্রহণে কৃষকেরা পিছিয়ে পড়ছেন

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ কৃষিক্ষেত্রে বেশ কিছু বড় পরিবর্তন এনেছে—জলবায়ু-সহনশীল বীজ, উচ্চ ফলনশীল ধান, আধুনিক সবজি চাষ পদ্ধতি, অর্গানিক উৎপাদন, কৃষকের মোবাইল অ্যাপস, ডিজিটাল রোগ নির্ণয় ইত্যাদি।

কিন্তু মাদারীপুরের কৃষকেরা এসব প্রযুক্তির অনেককিছুই জানেন না। কারণ, ইউনিয়ন পর্যায়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা না থাকায় কৃষকদের বাড়ি বা মাঠে গিয়ে এসব প্রযুক্তি প্রচার করার সুযোগ কমে গেছে।

কৃষিপণ্য বাজার ব্যবস্থাপনাতেও প্রভাব

কৃষিপণ্যের উৎপাদন পরবর্তী ব্যবস্থাপনা—যেমন সংরক্ষণ, সঠিক সময়ে বাজারজাত করা, পাইকারি বাজারের সঙ্গে যোগাযোগ, ন্যায্যমূল্য পাওয়া—এসব ক্ষেত্রেও কৃষি কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে।

কিন্তু কর্মকর্তা ঘাটতির কারণে এসব সেবা ঠিকমতো পৌঁছাচ্ছে না। ফলে অনেক সময় কৃষকেরা ফসল নষ্ট করে ফেলে বা কম দামে বিক্রি করেন। এতে কৃষকের ক্ষতি বাড়ছে।

সরকারের কাছে বাড়তি জনবল চাহিদা পাঠানো হয়েছে

এ বিষয়ে মাদারীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. রহিমা খাতুন জানান,
“আমরা ইতিমধ্যেই জনবল সংকটের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জানিয়েছি। আশা করছি খুব দ্রুত নতুন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা নিয়োগ হবে। তাহলেই ইউনিয়নভিত্তিক সেবার ঘাটতি কমবে এবং কৃষকেরা উপকৃত হবে।”

তাঁর মতে, জেলায় কর্মরত কর্মকর্তারা যতটুকু সম্ভব সেবা দিতে চেষ্টা করছেন, তবে বিশাল এলাকার তুলনায় জনবল খুবই কম হওয়ায় তা যথেষ্ট হচ্ছে না।

কৃষি কর্মকর্তার সংকটে যেসব বড় সমস্যা তৈরি হচ্ছে

১. রোগবালাই শনাক্তে বিলম্ব
২. ভুল কীটনাশক ও সার ব্যবহারে ফসলের ক্ষতি
৩. ফসলের উৎপাদন কমে যাওয়া
৪. নতুন প্রযুক্তি গ্রহণে কৃষকের অনীহা
৫. সবজি বা ধান উৎপাদনে ব্যয় বেড়ে যাওয়া
৬. ফসলের বাজারজাতকরণে সমস্যা
৭. কৃষকের আয় বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়া

কৃষি অর্থনীতিবিদদের মতে, একজন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা না থাকলে একটি ইউনিয়নের অন্তত ৮০০ থেকে ১২০০ কৃষক সরাসরি বা পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। মাদারীপুরে ৭৩ জন কর্মকর্তা না থাকায় কয়েক হাজার কৃষক এর প্রভাব বহন করছেন।

কৃষকের আকাঙ্ক্ষা: নিয়মিত মাঠপর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তা চাই

কৃষকেরা বলছেন, তাঁরা আর কোনো উপকার আশা করেন না—শুধু নিয়মিত একজন কর্মকর্তার দিকনির্দেশনা পেলেই তাঁরা ভালো ফলন পাবেন, ব্যয় কমবে, কৃষিকাজে আত্মবিশ্বাস বাড়বে।

প্রযুক্তির যুগে কৃষিকাজ এখন শুধু কঠোর শ্রম নয়; প্রয়োজন সঠিক জ্ঞান, সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত এবং পেশাদার পরামর্শ। আর সে পরামর্শ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে মাদারীপুরের কৃষকেরা।

একটি জেলার কৃষি ব্যবস্থায় ৭৩ শূন্য পদ—এর প্রভাব দেশব্যাপী

বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা কৃষকের উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল। মাদারীপুরের মতো কৃষিনির্ভর জেলায় এত বড় সংখ্যক শূন্য পদ থাকায়—

  • খাদ্য উৎপাদনের সামগ্রিক লক্ষ্যমাত্রায় প্রভাব পড়তে পারে
  • বাজারে চাহিদা–যোগানের ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে
  • সার্বিক কৃষি উন্নয়ন পিছিয়ে পড়তে পারে

তাই শুধু মাদারীপুর নয়, পুরো দেশের কৃষি উন্নয়নে এই সংকট দ্রুত সমাধান করা জরুরি।

মাদারীপুরের কৃষকেরা আজ যে সমস্যায় পড়েছেন, তা শুধু জনবল সংকটের বিষয় নয়—এটি একটি জেলার ভিত্তিগত কৃষি সেবা কাঠামোর সংকট। কৃষি কর্মকর্তাদের ঘাটতি পূরণ হলে যেমন কৃষকেরা উপকৃত হবেন, তেমনি দেশের খাদ্য উৎপাদনও আরও স্থিতিশীল হবে।

কৃষকেরা আশায় আছেন—
একদিন তাঁদের ইউনিয়নে নিয়মিত কৃষি কর্মকর্তা থাকবেন,
তাঁদের জমিতে সঠিক সময়ে সঠিক পরামর্শ পৌঁছাবে,
আর সেই দিনই কৃষি হবে আরও লাভজনক, আরও টেকসই।

MAH – 13953 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button