রাষ্ট্র সুযোগ দিলে মসজিদের ইমামরা সমাজের চিত্র পাল্টে দিতে পারেন: শায়খ আহমাদুল্লাহ
জনপ্রিয় ইসলামী আলোচক শায়খ আহমাদুল্লাহ মন্তব্য করেছেন যে, রাষ্ট্র সুযোগ দিলে মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনরা সমাজের জন্য অনেক কিছু করতে পারেন। তাঁদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের সামগ্রিক চিত্র পাল্টে দেওয়া সম্ভব। রবিবার (৩১ নভেম্বর) রাজধানীর চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত এক ইমাম ও খতিব সম্মেলনে বক্তব্যককালে তিনি এই গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেন।
শায়খ আহমাদুল্লাহ তাঁর বক্তব্যে দেশের ৩ লাখ মসজিদের ৬ লাখ ইমাম-মুয়াজ্জিনের নিরলস প্রচেষ্টার কথা তুলে ধরেন। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, স্বাধীনতার এত বছর পরও এই রাষ্ট্র ইমাম-মুয়াজ্জিনদের কোনো অবদানের নূন্যতম স্বীকৃতি দেয়নি। তাঁর মতে, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা এবং সামাজিক কুসংস্কার দূরীকরণে এই বিশাল জনশক্তিকে কাজে লাগানোর সুযোগ এখনও রয়েছে।
রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সুযোগের অভাব: ইমামদের বর্তমান পরিস্থিতি
মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনরা সমাজের একটি অপরিহার্য অংশ হলেও, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তাঁদের কাজের স্বীকৃতি ও সুযোগ তুলনামূলকভাবে কম।
৬ লাখ ইমাম-মুয়াজ্জিনের চেষ্টা: শায়খ আহমাদুল্লাহ বলেন, দেশের প্রায় ৩ লাখ মসজিদের সঙ্গে যুক্ত ৬ লাখ ইমাম-মুয়াজ্জিন প্রতিনিয়ত এই রাষ্ট্রকে কিছু না কিছু দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তাঁরা প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আগে ও পরে মুসল্লিদের সঙ্গে কথা বলেন, সামাজিক বার্তা দেন এবং নৈতিক শিক্ষার প্রসার ঘটান।
স্বীকৃতির অভাব: তিনি মনে করেন, সমাজের এই গুরুত্বপূর্ণ অংশটি স্বাধীনতার এত বছর পরেও রাষ্ট্রের কাছ থেকে ন্যূনতম স্বীকৃতি পাননি। তাঁদের কাজের ক্ষেত্র শুধুমাত্র মসজিদ বা ধর্মীয় গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ না রেখে যদি বৃহত্তর সামাজিক পরিসরে বিস্তৃত করা যায়, তবে তাঁরা আরও বেশি অবদান রাখতে পারবেন।
অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে তুলনা: তাঁর মতে, দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীর যেমন অবদান রয়েছে, তেমনি এই দেশের মসজিদের মিম্বারগুলোর অবদানও কম নয়। নৈতিকতা ও সামাজিক শৃঙ্খলার ভিত্তি তৈরিতে ইমামদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
জাতীয় স্বনির্ভরতা ও পরিবেশ সুরক্ষায় ইমামদের ভূমিকা
ইমামদের দেওয়া উপদেশ ও বার্তা সমাজের গভীর পর্যন্ত পৌঁছায়, যা জাতীয় লক্ষ্য অর্জনে একটি শক্তিশালী মাধ্যম হতে পারে।
স্বনির্ভর বাংলাদেশ গঠন: আহমাদুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশকে যদি স্বনির্ভর করতে হয়, তবে ইমাম-মুয়াজ্জিনদের শুধু কাজের সুযোগ দিলেই বাংলাদেশের চেহারা পরিবর্তন করতে আর কিছুর তেমন প্রয়োজন হবে না। তাঁদের বক্তব্যের মাধ্যমে সততা, শ্রমের মর্যাদা এবং অপচয় রোধের মতো অর্থনৈতিক নীতিগুলি সমাজের তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব।
পরিবেশ বিপর্যয় রোধ: জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ বিপর্যয় আজ বাংলাদেশের একটি প্রধান সমস্যা। ইমামরা জুমার খুতবা বা ওয়াজ-নসিহতের মাধ্যমে মানুষকে বৃক্ষরোপণ, পরিচ্ছন্নতা, পানি ও সম্পদের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন, যা পরিবেশ রক্ষায় ব্যাপক প্রভাব ফেলবে।
জনসংখ্যার সচেতনতা: স্বাস্থ্য, পুষ্টি এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মতো গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুগুলোতে সচেতনতা বৃদ্ধিতে মসজিদের প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করা যেতে পারে।
দুর্যোগ মোকাবিলা ও সামাজিক সমস্যা সমাধানে নীরব অবদান
জাতীয় যেকোনো সংকট বা সামাজিক বিপর্যয়ের সময় ইমামরা প্রায়শই নিঃস্বার্থভাবে জনগণের পাশে এসে দাঁড়ান, যা তাঁদের তাৎক্ষণিক সামাজিক ভূমিকার প্রমাণ দেয়।
রোহিঙ্গা সংকটে ভূমিকা: আলোচিত ইসলামী বক্তা বলেন, রোহিঙ্গারা যখন বাংলাদেশে আসতে শুরু করেছিলেন, তখন সবার আগে তাঁদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন ইমামরা। তাঁরা নিজ উদ্যোগে অর্থ ও ত্রাণ সংগ্রহ করেছেন এবং অসহায়দের পাশে দাঁড়িয়েছেন। এভাবেই প্রতিটা বিপদে নিঃস্বার্থভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েন ইমামরা।
যৌতুক প্রথা বিলোপ: বাংলাদেশের সমাজ থেকে যৌতুকের মতো অভিশাপ দূর করার পেছনে ওলামা সমাজের অবদানকে তিনি অন্যতম ক্রেডিট হিসেবে উল্লেখ করেন। মসজিদের মিম্বর থেকে যৌতুক বিরোধী প্রচারণা ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এর কঠোর নিন্দা সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে।
আইনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতা: ইমামরা সর্বদা সমাজের মানুষকে আইন মানতে এবং অন্যায় কাজ থেকে দূরে থাকতে উৎসাহিত করেন। এটি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজের সহায়ক হিসেবে কাজ করে এবং একটি নৈতিক সমাজ গঠনে অবদান রাখে।
মসজিদকে সামাজিক কেন্দ্রে রূপান্তর ও সু-নাগরিক গড়ার তাগিদ
মসজিদ কেবল ইবাদতের স্থান নয়, বরং এটি একটি সামাজিক ও শিক্ষামূলক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার সম্ভাবনা রয়েছে।
মসজিদ ভিত্তিক শিক্ষা: মসজিদগুলোকে যদি শুধুমাত্র ধর্মীয় শিক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না রেখে, প্রাথমিক সাক্ষরতা, বয়স্ক শিক্ষা, কম্পিউটার প্রশিক্ষণ এবং স্বাস্থ্য সচেতনতা মূলক কর্মসূচির কেন্দ্রে পরিণত করা হয়, তবে তা সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশকে এগিয়ে নিয়ে আসতে সাহায্য করবে।
ভালো নাগরিক তৈরি: শায়খ আহমাদুল্লাহ জোর দিয়ে বলেন, আমরা যদি ভালো নাগরিক গড়ে তুলতে চাই, তাহলে মসজিদগুলোকে ভালো নাগরিক তৈরির আঁতুড়ঘর হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। ইমামদের মাধ্যমে নাগরিকদের অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা যেতে পারে।
জাতীয় ঐক্য: ধর্মীয় উৎসব বা জাতীয় দিবসে মসজিদগুলো একতা ও সম্প্রীতির বার্তা ছড়িয়ে দিতে পারে, যা জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে।
শায়খ আহমাদুল্লাহ: “দেশের ৩ লাখ মসেজিদের ৬ লাখ ইমাম-মুয়াজ্জিন প্রতিনিয়ত এই রাষ্ট্রকে কিছু দেয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, স্বাধীনতার এত বছর পরও এই রাষ্ট্র ইমাম-মুয়াজ্জিনদের কোনো অবদানের নূন্যতম স্বীকৃতি দেয়নি।”
রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও ভবিষ্যতের পথ
ইমামদের জন্য রাষ্ট্রীয় সুযোগ বা ভাতার বিষয়টি বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক আলোচনায় উঠে এসেছে।
ভাতার পরিকল্পনা: অন্য একটি রাজনৈতিক দলের (বিএনপি) পক্ষ থেকে ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের ভাতা দেওয়ার পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে। এই ধরনের রাজনৈতিক অঙ্গীকার ইমাম সমাজের প্রতি রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতা সৃষ্টির একটি ইঙ্গিত।
রাষ্ট্রের দায়িত্ব: আহমাদুল্লাহ মনে করেন, শুধু ভাতা দেওয়া নয়, বরং ইমামদের কাজের পরিবেশ উন্নত করা, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং তাঁদের সামাজিক ভূমিকাকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া রাষ্ট্রের জন্য বেশি জরুরি।
বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ: বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই বিপুল সংখ্যক ধর্মীয় নেতাকে জাতীয় উন্নয়নের মূল স্রোতে যুক্ত করতে পারলে, এটি দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় ধরনের ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সামাজিক পরিবর্তনে ইমামদের সম্ভাবনা
জনপ্রিয় ইসলামী আলোচক শায়খ আহমাদুল্লাহর এই বক্তব্য বাংলাদেশের ধর্মীয় নেতাদের সামাজিক সম্ভাবনাকে নতুন করে সামনে এনেছে। তাঁর দাবি অনুযায়ী, যদি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে এই ৬ লাখ ইমাম-মুয়াজ্জিনকে শুধু ধর্মীয় কাজ নয়, বরং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত বিভিন্ন কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়, তবে তাঁরা নিঃসন্দেহে সমাজের চিত্র পাল্টে দিতে পারেন। যৌতুক নিরসন থেকে শুরু করে দুর্যোগ মোকাবিলা পর্যন্ত তাঁদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ প্রমাণ করে যে, যথাযথ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও প্রশিক্ষণ পেলে মসজিদগুলো হতে পারে সামাজিক পরিবর্তনের মূল কেন্দ্র। এখন দেখার বিষয়, রাষ্ট্র এই বিশাল জনশক্তিকে জাতীয় উন্নয়নের মূল ধারায় যুক্ত করার জন্য কী ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ গ্রহণ করে।
এম আর এম – ২৩৫৩,Signalbd.com



